*****লিলটি **
মাছ ধরাটা কেমন যেন আমার নেশায় দাঁড়িয়ে গেছে। আজকাল রোজই বেলেঘাটার সুভাষ সরবরে টিকিট কেটে ছিপ ফেলে বসে থাকি ঘন্টার
পর ঘন্টা ফাতনার দিকে তাকিয়ে।
আজও বসেছিলাম। শ্রাবণমাস টিপ টিপ করে বৃষ্টি পরছে, এক দৃষ্টিতে জলে ফেলা দুটো ছিপের ফাতনার দিকে তাকিয়ে ছাতার নিচে বসে আছি।
পাশের ঘাটে তিনটি অল্প বয়েসি কিশোর ছেলে, কত বয়েস হবে এই পনেরো ষোলো, উদ্যাম
ঝাঁপিয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে তোরে বৃষ্টি নামছে, ওদের ঝাপাঝাপি ও বেড়ে যাচ্ছে। আবার তাকিয়ে আছি ফাতনার দিকে, কয়েকটা জল মাকড়সা বড়শির চারপাশে যেন জল আল্পনা দিচ্ছে। সারা লেকের জল যেন বৃষ্টির জলের ছন্দে টুং টাং করে
নুপূর বাজাচ্ছে। কেমন যেন আনমনা হয়ে গেলাম, মনটা চলে গেলো সুদূর অতিতের ফেলে আসা দিন গুলিতে।আমরা তখন থাকি বেলেঘাটার ভাড়া
বাড়ি রাসমনি বাজারে। সাত ঘর এক উঠান। বড় হয়ে নাম করা এক সাহিত্যিকের একটা উপন্যাস পড়েছিলাম, বারো ঘর এক উঠান নাম ছিল। যাই হোক তখন আমি দেশবন্ধু স্কুলে ক্লাস টেন এ পড়ি। আমাদের বাড়িতে আমাদেরই দুটো ঘর আর
রান্না ঘর, বাকি আর ছয় পরিবারের একটা ঘর, বারান্দায় একটু ঘেরা রান্না ঘর। আমারি বয়েসি আরো দুজন কিশোর ছেলে ভবেশ আর শিবু উল্টো দিকের ঘরে থাকে। গলায় গলায় ভাব
আমাদের তিন বন্ধুর। ওরাও স্কুলে পড়ে শিবু নাইনে পড়ে। আমাদের মধ্যে ভবেশ একটু পাকা ছিল, সব বিষয়ে ওর মাতব্বরি ছিল। বিকেল হলেই তিন বন্ধু হাফ প্যান্ট গেঞ্জি পরে সোজা লেকের মাঠে। মাঠে অন্য বন্ধুদের সাথে চুটিয়ে ফুটবল খেলে ঝাঁপিয়ে
পরতাম লেকের জলে। বাড়ি ফিরে।বাবার হাতে মার খেয়ে বই খাতা নিয়ে পড়তে বসতাম। অদ্ভুত একটা ব্যাপার ছিল, পড়ার বই নিয়ে বসলেই রাজ্যের ঘুম আর কোথাও জায়গা না পেয়ে
আমার চোখ দুটোকেই জায়গা বানিয়ে নিত। বইয়ের অক্ষর গুলো কেমন যেন আবছা হয়ে নাচানাচি করতো বইএর পাতার মাঝে। কতবার ঝিমুনিতে টেবিলের ওপরে বইয়ের সাথে
মাথা ঠুকে গেছে। আমাদের বাড়ির সব ঘর গুলো ফেস টু ফেস,মাঝখানে ঝকঝকে সিমেন্ট বাধানো উঠোন, উঠোনের সাথেই আমাদের ঘরের টানা সিমেন্ট করা বারান্দা।বাড়ির সবার সাথে সবার খুব সদ্ভাব।বাড়িওয়ালা পেছন দিকে আরেকটা
বাড়িতে থাকে। গরম কালে সন্ধ্যা হলেই বাড়ির মেয়েরা খুব সুন্দর করে উঠোন আর আমাদের বারান্দাটা ঝকঝকে করে মুছে দিত। আর রাতে শোবার সময় শুধু একটা করে বালিশ নিয়ে যে যেখানে পারতো খোলা আকাশের নিচে উঠোনে আর আমাদের বারান্দায় শুয়ে পোরতো।
চোখের সামনে তারায় ভরা আকাশ, স্নিগ্ধ বাতাস, উঠোনের কোণার পেয়ারা গাছের পাতার সর সর শব্দ, কখন যে সবাই ঘুমিয়ে পরতাম টেরই
পেতাম না। একদিন আমরা তিন বন্ধু লেকের মাঠে
খেলার পর গল্প করছি, হটাৎ ভবেশ দাঁড়িয়ে একটু ব্যায়ামের মতো হাত পা ছুড়ে বললো, চল আখড়ায় ভর্তি হয়ে যাই ব্যায়াম করবো। শরীরটাকে বানাতে হবে। যেমন কথা তেমন কাজ। খুঁজে খুঁজে বাড়ি থেকে হাটা দূরত্বে একটা আখড়ার খোঁজ পেলাম। তখন তো আজকের মত জিম ছিল না।
পরের দিন বিকেলেই হাজির হয়ে গেলাম আখড়াতে। কেষ্টদার আখড়া,ওর বাড়িতেই সামনের দিকে, এক টুকরো বাগানের মত রাস্তার দিকটা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা মাথার ওপর খোলা আকাশ।আখড়াটা একটা সরু গলির মধ্যে।
আখড়ার সামনের রাস্তার ওপরেই একটা পাকা দোতলা বাড়ি। বিরাট ঝুল বারান্দা।
ওখানে দাঁড়ালেই আমাদের আখড়ার সব চোখের সামনে । যাই হোক কেষ্টদা আমাদের ভর্তি করে নিলো। আমরা তিনজনেই খুব এক্সাইটেড। তখন স্কুলের গরমের ছুটি শুরু হয়েছে, এক মাস ছুটি।
পরের দিন বিকেল চারটে বাজতে না বাজতেই আমরা তিন মুর্তি আখড়ায় হাজির। কেষ্টদা বলে দিয়েছিল আজনাকি ব্যায়ামের ইনস্ট্রাক্টর ভোলাদা
আসবেন, সব কিছু দেখাবার জন্য।
আর কেষ্টদার কথা অনুযায়ী তিনজনে তিনটে ল্যাংগোট কিনে নিয়েছিলাম।এখনকার ছেলেরা ল্যাংগোট কি তাই জানে না। নিয়ম খালি গায় ল্যাংগোট কষে ব্যায়াম করতে হবে। আমাদের
আখড়ায় বারবেল,ডাম্বেল, প্যারালাল বার, রিং, বুক ডন দেয়ার কাঠের ব্লক সব ছিল। যথা সময়ে ভোলাদা এলেন।পরনে ফুল প্যান্ট আর গোল গলা গেঞ্জি। এসেই গেঞ্জিটা খুলে ফেললেন। উফফ কি বডি। হাত নাড়াচ্ছেতো বাইসেফ ট্রাইসেপ ফুলে উঠছে, ঘাড় ঘোরাচ্ছে সোল্ডার ঠেলে উঠছে, আর পেট আজ কাল কি যেন বলে প্যাক।
পুরোন স্টুডেন্ট দের কিছু ইন্সট্রাকশন দিয়ে আমাদের তিন জনের কাছে এসে তিক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাদের জরিপ করলেন,আমরা লাংগোট পড়ে খালি গায়ে দাঁড়িয়েছিলাম। আমাদের উনি
কি করে বুকডন, বৈঠকি দিতে হয় দেখিয়ে দিলেন। শুরু হলো আমাদের শরীরচর্চা। এই ভাবে দিন আসে দিন যায়, আখড়ার পাড়ার অনেকের সাথে
পরিচয় হয়ে গেছে। রোজ বিকেল চারটের সময় আখড়ায় গিয়ে জামা প্যান্ট খুলে ল্যাংগোট পরে খালি গায় গা ঘামানো শুরু হতো। কয়েক দিন
হলো লক্ষ করছি একটি ফুটফুটে ফরসা মিষ্টি দেখতে মেয়ে বাড়ির ব্যালকনি তে দাঁড়িয়ে থাকে, মোটামুটি বছর পনেরো বয়েস হবে। খুব সুন্দরী, ব্যায়াম করতে করতে চোখ চলে যায় ওপরে, চোখের আর কি দোষ তখন আমাদের সম বয়েসি যে মেয়েকেই দেখি কেমন রাজকন্যা রাজকন্যা মনে হয়। লক্ষ করে দেখেছি ও এমন ভাব
করে দাঁড়িয়ে থাকতো যেন আমাদের দেখছে না,কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারতাম আমাকে দেখছে। কেমন যেন লজ্জা লজ্জা করতো খালি গা শুধু মাত্র একটা লাংগোট পরা। একদিন হটাত চোখে চোখ পরতেই ফিক করে হেসে ফেলেছে। আমিতো লজ্জায় লাল। বলতে নেই আমি কিন্তু যথেষ্ট ফরসা ছিলাম, ঝাকড়া চুল সদ্য ঠোঁটের ওপরে কালো গোঁফের রেখা। ওর মিষ্টি হাসি দেখে
কেমন যেন নিজেকে হিরো হিরো মনে হওয়া শুরু হোলো। ভবেশ আর শিবুকে বললাম, ওরাও লক্ষ করেছে মেয়েটিকে। আমাদের আখড়ার কাছেই
আমার স্কুলের দুলাল নামে একটি ছেলে থাকে, পাড়ায় একটু ডাকাবুকো। ব্যায়াম শেষে ওর সাথে
মাঝে মাঝে গল্প করি।ওর কাছ থেকে জানতে পারলাম, মেয়েটির নাম লিলটি। ক্লাস নাইনে পড়ে। রোজই চোখা চোখি হয় আর ও মিটিমিটি হাসে। এক দিন দেখি আরো দুটো মেয়ে ওর সাথে ওর ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে। দুলালকে জিগ্যেস করাতে জানলাম লিলটির বন্ধু অমিতা আর রিনি, এই পাড়াতেই থাকে।রোজই ওরা তিনজন আজকাল দাঁড়িয়ে থাকে ব্যালকনিতে আমাদের ব্যায়ামের সময়। এবার আমরা তিনজন ওরা তিন জন।একদিন বিকেলে ব্যায়ামের রেস্ট ডে তে আমি
ভবেশ আর শিবু লেকের মাঠে বসে মিটিং করে আমরা তিনজন লিলটিদের তিন জনকে ভাগ করে নিলাম। আমার ভাগে লিলটি যেহেতু আগেই লিলটির সাথে আমার ফিক ফিকানি হাসির
একটা রিলেশনশিপ তৈরী হয়ে গেছে ভবেশের ভাগে আমিতা, কারন ভবেশের মতো আমিতাও একটু পাকা পাকা ভাবের আর ছোট্ট রিনি শিবুর।
ব্যাস ভাগাভাগি কম্পলিট,কারো কোনো আপসোস রইল না।
এই ভাবে দিন কেটে যায় তিন জনই নিজেদের একটু হিরো হিরো ভাব আনার চেষ্টা করে যাচ্ছি সেই সংগে ব্যায়ামও চলছে পুরদমে।
এক দিন হটাৎ দুলাল খবর পাঠালো ব্যায়ামের পর ওর সাথে দেখা করতে।
কাছেই দুলালের বাড়ি। দেখা হতেই দুলাল স্কুলের খাতার পাতার তিনটে ভাজ করা কাগজ আমাদের তিন জনের হাতে দিল।
খুলে দেখি তিনটে চিঠি একই বয়ান, লেখা আছে
ভালোবাসা কাকে বলে জানি না কিন্তু ভালো লাগে, দেখা করতে ইচ্ছে করছে। আমার চিঠির নিচে লিলটি, ভবেশের চিঠিতে অমিতা আর শিবুর চিঠিতে রিনির নাম। বুঝলাম আমাদেরই
মতো ওরাও আমাদেরকেও ভাগ করে নিয়েছে।
ওই কটা লাইন পড়ার সাথে সাথে মনে হোলো সমস্ত প্রকৃতিটাই যেন পালটে গেলো, মনে হোলো পৃথিবীতে আর কোনো ঋতু নেই শুধু বসন্ত আর বসন্ত। দুলাল ও আমার কাছে হয়ে গেলো বসন্তের মাঝে শ্রাবণের কালিদাসের মেঘদূত।
আমরাও দুলালের কাছ থেকে পেন আর কাগজ নিয়ে লিখে দিলাম, কাল সান ডে বিকেল পাঁচটার সময় বেলেঘাটা খালের ধারে মিট করতে।
দুলালের হাত দিয়েই আমাদের নায়িকা
দের কাছে পাঠিয়ে দিলাম।
সে দিন স্বপ্নের ঘোরে আমরা তিন জন
বাড়ি ফিরেছিলাম চিঠিটাকে বুক পকেটে চেপে ধরে,জীবনের প্রথম প্রেম পত্র। পরের দিন ঠিক পাঁচটার সময় ওরা এসেছিলো, আমরা তিন হাফ প্যান্ট পরা হিরো আর তিন ফ্রক পরা হিরোইন। মনে আছে ঘন্টা খানেক আমরা পাশা পাশি দুজন
করে খালের জলের ধার দিয়ে হেটেছিলাম। আমরা কেউই তখন জানতাম না প্রেম কাকে বলে, প্রেমের কথা কি বলতে হয়। শুধু বুঝতে পারছিলাম খুব খুব ভালো লাগছে লিলটির পাশে পাশে হাটতে আর মনে হচ্ছিল সারা জীবন যেন
এই ভাবেই লিলটির পাশে পাশে হেটে যেতে পারি,এই হাটার পথ যেন শেষ না হয়।
হটাৎ কিছু মানুষের চিৎকার শুনে সম্বিত ফিরে এলো, দেখি একটা বড়শীতে মাছ গেঁথেছে, ছিপটা হাতে তুলে নিলাম, ছিপটা ধনুকের মত বেঁকে
যাচ্ছে, বুঝলাম ছয় সাত কিলোর মাছ
গেঁথেছে। শুরু হয়ে গেলো স্বপ্ন আর বাস্তবের টানা টানির খেলা। কে জেতে কে হারে।
********** নন্দিনী ***** *****
আজ বেলেঘাটার পশ এলাকা সি আই টি রোডের মোড়ে পোস্ট অফিসের পাশে নিজের চার তলা বাড়ির ব্যালকনিতে বসে এক কাপ চা নিয়ে শেষ শ্রাবণের বৃষ্টি দেখতে দেখতে নীল
ভাবছিলো, রাসমনি বাজারের সেই সাত ঘর এক উঠোন ভাড়া বাড়ি থেকে এই আজকের ঝকঝকে সি আই টি রোডের এই চার তলা বাড়িতে আসতে নীল কে কত গুলো বছর কত
পরিশ্রম করতে হয়েছে। আজ সেই সাত ঘর এক উঠোন বাড়িটা আর নেই, আজকের প্রোমোটারের বদান্যতায় বিশাল মাল্টি স্টোরিড বিল্ডিং হয়ে গেছে। রাসমনি বাজারের সেই পুরান বাড়িটাতে গেথে আছে নীলের, কৈশোরের শিকড়।
আজ কোথায় হারিয়ে গেছে ভবেশ, শিবু, সেই কেষ্টদার ব্যায়ামের আখড়া।
ওদের কথা মনে পড়লেই মনে পড়ে যায়, একটা ফ্রক পরা কিশোরী , জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া লিলটি। আজকাল ভালো করে লিলটির মুখটাও মনে করতে পারে না নীল।
শুধু মনে পড়ে স্কুলের লাইনটানা খাতার একটা পাতায় গোটগোট করে লেখা কয়েকটা কথা। আজো নীল ভুলতে পারেনা সেই জীবনের প্রথম পাওয়া কয়েকটি কথা, ভালোবাসা কাকে
বলে জানি না কিন্তু ভালো লাগে, খুব দেখা করতে ইচ্ছে করছে।
বাইরে অঝোরে ঝরে চলেছে শেষ শ্রাবণের বৃষ্টি। মনটা কেমন জানি হারিয়ে যাচ্ছে অতিতের এক স্বর্ণালী বিকেলে, চোখের সামনে নীল দেখতে পাচ্ছে তিনটে হাফ প্যান্ট পরা কিশোর
আর তিনটে ফ্রক পড়া কিশোরীর ছবি। সেদিন লিলটির সাথে খাল পারের জলের ধার দিয়ে হাটতে হাটতে নীলের খালি মনে হচ্ছিল, এটাকেই কি ভালোবাসা বলে? না হলে এত ভালো
লাগছে কেন লিলটির পাশে পাশে হাটতে। এক দিন নীল ভবেশ আর শিবু কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়িতে লুকিয়ে স্কুলের টিফিন থেকে কিছু পয়সা জমিয়ে আলোছায়ায় উত্তম কুমার সুচিত্রা সেনের একটা সদ্য বের হওয়া সিনেমা দেখেছিলো পথে হোলো দেরী। সিনেমাটার শেষ সিনে সুচিত্রা সেন ঝাঁপিয়ে পড়বে উত্তম কুমারের বুকে, আর উত্তমকুমার সুচিত্রা সেনকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে অনেক্ষণ।
সেই দৃশ্যটা মন থেকে নীল ভুলতে পারতো না, শরীরের মধ্যে কেমন জানি একটা রোমাঞ্চ ছড়িয়ে পড়তো। সেদিন খাল পারে হাটতে হাটতে নীল সেই শিহরণটা অনুভব করছিল আর খুব ইচ্ছে করছিল ওর লিলটিও যদি ওই ভাবে ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তো আর নীলও উত্তম কুমারের মত লিলটিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে অনুভব করতো লিলটির নরম শরীরের উত্তাপ।আজ ব্যালকনিতে বোসে নীল ভাবে সেদিনের সেই হাফ প্যান্ট পরা কিশোর ছেলেটির অনুভূতিই কি ছিলো, নীলের জীবনের প্রথম প্রেম?
সকলের জীবনেই ছোট বেলাটা যেন ফাস্ট ফরয়ার্ড করা সিনেমার মত, দেখতে দেখতে কেটে যায়, পেছনে ফেলে রাখে অনেক ঘটনার স্মৃতি। অনেক গুলো ছোট ছোট ঘটনার জন্য নীল ভবেশ আর শিবু ছেড়ে দিয়েছিল সেই ব্যায়ামের আখড়া। তার পর কেটে গেছে অনেক দিন, হাজার সূর্য অস্ত গিয়েছে নীলের জীবনে। ভুলে গেছে ছোট বেলার কথা ভুলতে পারেনি শুধু লিলটির কথা। মনের মধ্যে তখন একটাই জেদ ছিল লেখাপড়া করে নিজের কেরিয়ারটাকে
তৈরী করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
আজ নীল রয় একজন প্রতিষ্ঠিত বিজনেস ম্যান। কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে লেদার টেকনোলজি তে ডিগ্রী কোর্স কম্পলিট করে আজ বানতলাতে বিরাট ফ্যাক্টরির মালিক।
তারই সংগে জোকাতে দুটো লেদার গুডসের ইউনিট।পুরোটাই এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড। মাঝে মাঝে বিদেশ যেতে হয় এক্সপোর্ট প্রোমোশনের জন্য। বিয়ের কথাটা এখনো ভেবে
উঠতে পারেনি নীল, মনের কোথায় কোন কোণে যেন একটা মিষ্টি ফ্রক পরা মেয়ে মাঝে মাঝে উকি দেয়। ভাবে কোথায় আছে এখন লিলটি কে জানে, হয়তো বিয়ে থা করে গিন্নিবান্নী
হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে মন খারাপ হলে নীল ওর সেই ছোট বেলার হারিয়ে যাওয়া প্রেম লিলটির মুখটা মনে করার চেষ্টা করে। ভালো লাগছে না কাল আবার দুপুরের ফ্লাইটে
যেতে হবে চেন্নাই, ওখানে কাল থেকে লেদার ফেয়ার শুরু হচ্ছে আর এবারে কলকাতার নীল রয় চিফ গেস্ট।পরের দিন ঠিক তিনটের ফ্লাইট, নাম্বার Indigo 6E 305 সিসিইউ টু চেন্নাই একটা ছোট্ট ব্যাগ নিয়ে উঠে বসলো নীল প্লেনে।
নন্দিনী সেন, ঝকঝকে খুবই সুন্দরী একটি মেয়ে একটা ট্রলিব্যাগ টানতে টানতে দমদম এয়ার পোর্টের ডোমেস্টিক গেট দিয়ে ঢুকছে। পরনে ব্লু স্কার্ট সুট গলায় পিংক টাই তাতে ইন্ডিগো এয়ার লাইন্সের লোগো, সুন্দর করে চুলে খোপা বাধা, চোখে আই লাইনার ঠোঁটে টাইয়ের সাথে ম্যাচিং পিংক কালারের লিপস্টিক হাই হিল, ইন্ডিগো এয়ারলাইন্সের সব থেকে সুন্দরী এয়ার হোস্টেস। আজকের ফ্লাইট সিসিইউ টু চেন্নাই 6E 305 ভায়া বেঙ্গালোর টু কলকাতা। এয়াপোর্টে
ঢোকার পর থেকে যতক্ষণ না ডেস্টিনেশন এয়ারপোর্ট গ্রাউন্ড টাচ করছে, এক মিনিটও বিশ্রাম নেই কেবিন ক্রুদের। শিডিউল টাইমে এয়ারপোর্ট এ পৌছনো, এয়ারলাইন্স কাউন্টারে কিছু ফরমাল সইসাবুদ, তার পর প্যাসেঞ্জার কলিং এর আগেই সব ক্রু পাইলট সবাইকে এয়ারক্রাফট এ ঢুকে যেতে হয়। আজও যথারীতি সিডিউল মেনে নন্দিনী এয়ারক্র্যাফটে ঢুকে প্রাথমিক যাযা করনীয় করে নিয়েছ আজ এই ফ্লাইটে দুজন এয়ার হোসটেস, নন্দিনী আর রিয়া।
সময় হয়ে গেছে, প্যাসেঞ্জার বাস থেকে নেমে, প্যাসেঞ্জাররা আস্তে আস্তে এয়ারক্র্যাফটে ঢুকছে, রিয়া সকলের বোর্ডিং পাস চেক করে যার যার সিট দেখিয়ে দিচ্ছে। সবাই বসে গেলে
নন্দিনীর ডিউটি প্রত্যেকটা সিটের কাছে গিয়ে লিস্টের সাথে তাদের আই ডি মিলিয়ে নেওয়া। এয়ার লাইন্সের রুল অনুযায়ী আজকাল লিস্টের প্রত্যেকটা নামের পাশে তাদের কন্টাক্ট
মোবাইল নাম্বার লেখা থাকে। নন্দিনী সব চেক করতে করতে লাস্ট নামের প্যাসেঞ্জারের সামনে এসে দাঁড়ালো। মিষ্টার নীলাদ্রি সেন। নামটা পড়তেই চমকে ওঠে নন্দিনীর ভেতরের
সেই ছোট বেলার লিলটি। অনেক অনেক দিন আগের একটা নাম ঝিলিক দিয়ে ওঠে মনের কোণে। আই ডি চেক করতে গিয়ে দেখে বেলেঘাটার সি আই টি রোডের এড্রেস। এবার পুরো কনফার্ম হয়ে যায় লিলটি এই সেই হারিয়ে যাওয়া ওর ছোট বেলার ভালো লাগা ছেলেটি
কেষ্টদার ব্যায়ামের আখড়ার নীল। নীলও খুব অবাক হয়ে নন্দিনীকে দেখছিল, কি চোখ জুড়ানো মিষ্টি একটা মুখ, স্মার্ট সপ্রতিভ একটা মেয়ে, অনেক্ষণ ধোরে ওকে দেখছে, নীলের কেমন যেন মনে হচ্ছে মেয়েটির টানাটানা চোখ দুটো কি একটু ছলছল করছে? নীল ও কেমন যেন একটা অদ্ভুত এট্রাকশন ফিল করছে। অবাক হয়ে ভাবে নীল এরকম তো কোনো মেয়েকে দেখে ওর ফিলিংস হয় নি।
যথারীতি যথা সময়ে নন্দিনী ইন্টার্নাল এড্রেস সিস্টেমে প্যাসেঞ্জার এড্রেস দিতে দিতে দেখলো নীল এক দৃষ্টিতে ওকে দেখছে আর মনে হোলো কি যেন ভাবছে। শিডিউলে প্লেন টেক অফ
করলো। তিন ঘন্টার ফ্লাইট টাইম। এতক্ষণে নন্দিনী আর রিয়া একটু নিশ্বাস ফেলার সময় পেলো। নিজেদের ছোট্ট কেবিনের সিটে বসে নন্দিনী চোখটা বুঁজে হেলান দিলো। এখন আর কেউ ডাকবে না, ডাকলেও রিয়া আছে। চোখ বুঁজে থাকতে থাকতে চোখের সামনে ভেসে উঠলো, বেলেঘাটার খাল পাড়ের একটা দৃশ্য, তিনটি হাফ প্যান্ট পরা ছেলে আর ওরা ফ্রক পরা তিন
বন্ধু, ওই তিনটি ছেলের ভেতর সব থেকে সুন্দর ছেলেটি ওর সেদিনের নীল। আজ নীলকে প্লেনের মধ্যে দেখে সেদিনের সেই ফ্রক পরা লিলটির ভালো লাগার স্মৃতি গুলো এসে ভীর
করেছে আজকের নন্দিনীর মনে।... এতগুলো বছর কেটে গেছে, কত পরিবর্তন এসেছে জীবনে। গ্রাজুয়েশন কম্পলিট করে, কলকাতার Frankfinn Institute of Air Hostes and AviationTraining Centre থেকে দুবছরের ডিপ্লোমা করে এক বছর বাই পাসেরধারে একটা ফাইভ স্টার হোটেলে রিসেপশোনিস্টের কাজ করে ইন্ডিগো এয়ারলাইন্সের এয়ার হোস্টেসের এই চাকরী টা পেয়েছে। অনেক গুলো বছর নীলের সাথে কোনো যোগাযোগ ই নেই লিলটির। কিন্তু মনের কোনে জীবনের প্রথম ভালোবাসা ধিকি ধিকি করে মনটাকে অশান্ত করে রাখতো। এত গুলো বছরেও লিলটি ভুলতে পারেনি নীলকে। আজ আবার সামনে
দেখে বার বার চোখ দুটো জলে ভরে উঠছে। বুঝেছিল লিলটি ওর সেই কিশোরী মনের ভালোবাসা আজ পর্যন্ত অন্য কোনো ছেলেকে কেন মনের মাঝে আসতে দেয় নি।
প্যাসেঞ্জার লিস্ট থেকে নীলের মোবাইল নাম্বারটা সেভ করেনেয় নন্দিনী। যথা সময়ে শিডিউল তিন ঘন্টায় ইন্ডিগো এয়ার লাইন্সের ফ্লাইট নাম্বার ই ৬০৫ চেন্নাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ার
পোর্টের মাটি ছুলো।
এ্যাজ এয়ার লাইনস রুল এয়ার ক্রাফটের ডোর খুলে কেবিন ক্রু আর পাইলটস সব যাত্রিদের বিদায় সম্ভাষণ জানায়, সেই মতো নন্দিনী আর রিয়াও হাত জোড় করে সব যাত্রিদের বিদায়
জানাচ্ছে , সবাই আস্তে আস্তে হান্ডব্যাগস সাথে নেমে যাচ্ছে।
সব শেষের প্যাসেঞ্জার নীল হাতের ব্যাগটা নিয়ে নামতে গিয়ে নন্দিনীর সামনে এসে দাঁড়ালো। নন্দিনীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক সেকেন্ড, দেখে এয়ার হোস্টেস নন্দিনী এক
দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওর দিকে, সেই হরিণীর মত চোখ দুটিতে কি ব্যাকুলতা, নীলের যেন মনে হচ্ছে চোখ দুটি ওকে বলছে আমাকে ছেড়ে চলে যেওনা।
এক মন প্রশ্ন নিয়ে নেমে যায় নীল প্লেন থেকে তার পর ব্যাগেজ সহ এয়ারপোর্ট থেকে একটা ক্যাব নিয়ে রওনা হয় নীল ওর জন্য বুক করে রাখা চেন্নাইএর
হোটেল হিল্টনের দিকে।
আর এদিকে লিলটি আজকের এয়ার হোসটেস নন্দিনী ডিউটির সমস্ত ফর্মালিটি কম্পলিট করে নিজের ট্রলি ব্যাগ নিয়ে রিয়ার সংগে রওনা হয় ওদের জন্য নিদৃষ্ট হোটেল মেরিনা ইন এর দিকে।
হোটেল হিলটনের সেকেন্ড ফ্লোরের ২০৭ নং রুমে ফ্রেশ হয়ে নীল ইন্টারকমে এক কাপ কফির অর্ডার দিয়ে আরাম করে ব্যালকনির বেতের চেয়ারটাতে বসে আকাশের দিকে তাকালো,
পরিষ্কার আকাশ, সন্ধ্যা হয়ে গেছে, কাল থেকে দুটো দিন ফেয়ারের ইনাগুরেশন, স্টল ওপেনিং,তারপর মিটিং আরো কত কি। দুটো দিন খুব বিজি শিডিউল নীলের, আজ এইটুকু
সময় ওর একান্ত নিজের। হটাত প্লেনের খুব সুন্দরী এয়ার হোস্টেসের অদ্ভুত আচরণ নীলের মনে পড়ে গেলো। ওর ও কেমন যেন মনে হচ্ছে খুব চেনা একটা মুখ, নামার সময় সেই
ব্যাকুল দুটো চোখ ওর দিকে তাকিয়ে আছে যেন বলতে চাইছে পারছো না চিনতে আমাকে? আমি যে তোমার হারিয়ে যাওয়া অতিতের ভালোবাসা।
তবে কি ও লিলটি? যার জন্য এত বছর নীল অপেক্ষা করে করে আছে? এও কি সম্ভব?
কাল সকালেই বেড়িয়ে যেতে হবে ফেয়ার থেকে গাড়ী আসবেনীলের জন্য, তাই রাত দশটার মধ্যে ডিনার কম্পলিট করে এগারো টার মধ্যে শুয়ে পোড়ে নীল আকাশ পাতাল ভাবছে।
খালি মনে পড়ে যাচ্ছে এয়ার হোস্টেস মেয়েটির চোখ দুটি।
একটু তন্দ্রামতন হয়েছে নীল হটাত ওর মোবাইলটা বেজে উঠলো, আননোন নাম্বার, হ্যালো বলতেই একটি মেয়ের গলা তুমি নীল বোলছো? নীলের মনে হচ্ছে মনের মনিকোঠায়
অনেক যত্ন করে রাখা চেনা একটা গলার আওয়াজ, হা বলতেই আবার সেই মনের বীণার সপ্ত সুরের আওয়াজ বলছে নীল আজও আমি জানি না ভালোবাসা কাকে বলে কিন্তু
এখনো ভালো লাগে তোমাকে, খুব দেখা করতে ইচ্ছে করছে,হোটেল মেরিন ইন রুম নাম্বার ১০১ এ আমি আছি। আজ নিশ্চয়ই তোমাকে বলে দিতে হবে না আমি কে বলছি ।
* ***********
***** *** শুন্যতা *******
( " লিলটি আর নন্দিনী " র শেষ পর্ব।)
হোটেল হিল্টনের রুমে লিলটির ফোনটা পেয়ে নীলের মনে হচ্ছিল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মানুষের জীবনটা কেমন বদলে যেতে পারে,
মনটাকে অকাল বসন্তের কৃঁষ্ণচূড়ার রঙে রাঙিয়ে দিতে পারে ভাবতেও পারেনি ও। ফোনটা অফ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে নীল ব্যালকনিতে
এসে দাঁড়ালো। আকাশের দিকে তাকায় নীল, শ্রাবণ শেষ আকাশে আজ যেন তারার মেলা,আজ
একাদশী, এক ফালি চাঁদ আকাশে ঝকঝক করছে, আর তারা গুলো মিটমিট করে ঠোঁট টিপেটিপে হাসছে আর যেন ওকে বলছে, দেখলেতো কেমন পৃথিবী ছেড়ে অসীম নীল
আকাশের বুকে ২০ হাজার ফুট ওপরে তোমার লিলটি তোমাকে খুঁজে পেলো? আর ওকে হারিয়ে ফেলো না নিজের করে নিও। তর সইছে না আর, নীলের মনে হচ্ছে এখুনি ছুটে যায় ওর লিলটির
কাছে। বিছানায় শুয়ে পোড়ে মনেমনে ঠিক করে নেয়, সকালে ফেয়ারের গাড়ী নিয়েই আগে মেরিনা ইন এ যাবে, লিলটিকে সঙ্গে নিয়ে ফেয়ারে যাবে,
তার পর কত কিছু কল্পনা করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে নীল।
আজ সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে যায় নীলের, দশটায় গাড়ী আসবে, আগে মেরিনা ইনে যেতে হবে, তাই তারাতারি করে দাড়ি কেটে স্নান করে, ড্রেস আপ
করে নিলো, আজ নীল পরেছে ব্লু কালারের সুট, নিচে হোয়াইট সার্ট আর মাচিং স্ট্রাইপ টাই। আয়নার সামনে চুল ঠিক করতে করতে
নিজেকে দেখতে দেখতে নিজেই হেসে ফেলে নীল, আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকেই নিজে বলে, কত দিন কত বছর বাদে হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসাকে খুঁজে পেয়ে কেমন খুশিতে ডগমগ করছে দেখো।
ঠিক দশটার সময় গাড়ী এসেছে, হোটেলেই হাল্কা ব্রেকফাস্ট করে গাড়িতে গিয়ে বসলো নীল। ড্রাইভার কে বললো প্রথমে ও হোটেল মেরিনা
ইন এ যাবে। লোকাল ভাড়ার গাড়ী, ড্রাইভার সব কিছুই চেনে। গাড়ী ছুটলো মেরিনা বিচের দিকে। গাড়ীর পেছনের সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে নীল ভাবছিল, কি অদ্ভুত মানুষের ভাগ্যের লিখন। প্লেনে ওঠার সময়েও কি ভাবতে পেরেছিল নীল, যে মাটি থেকে কুড়ি হাজার ফিট ওপরে মেঘের ভেলায়
ভাসতে ভাসতে অতিতের হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসাকে খুঁজে পাবে?
সকালে বেড়োবার আগেই নীল লিলটিকে ফোন করে বলে দিয়েছিল এগারোটার মধ্যে ও মেরিনা ইনে পৌঁছোচ্ছে। খানিক্ষণ বাদে ড্রাভারের কথায় চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে মেরিনা ইন হোটেলে পৌঁছে গেছে। ভেতরে ঢুকে রিসেপশনে নন্দিনীর
কথা জিগ্যেস করতেই নীল জানতে পারলো, অল রেডি ওর কথা বলা আছে, যাতে নীল ডাইরেক্টলি দোতলায় রুম নাম্বার ১০১ এ যেতে পারে।
রিসেপশন থেকে জেনে নিয়ে নীল লিফটে দোতলায় নেমে একটু খুঁজে রুম নাম্বার ১০১ এর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডোর বেলটা বাজাল। আস্তে বন্ধ দরজাটা খুলে গেলো, নীল দেখলো
ওর সামনে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে আছে মনের গভীরে আঁকা হারিয়ে যাওয়া সেই প্রেম, যার জন্য এত গুলো বছর ধরে অপেক্ষা করে আছে কলকাতার
বিখ্যাত বিজনেসম্যান নীল রয়। ভালো করে তাকিয়ে দেখে কি সুন্দর করে সেজেছে আজকের নন্দিনী ওর কিশোর মনের লিলটি। পিংক কালারের সালওয়ার কামিজ সাথে ম্যাচিং দোপাট্টা,চোখে হালকা কাজল ঠোঁটে শুধু লিপগ্লস
ওর টুকটুকে ঠোঁট দুটোকে যেন ভিজিয়ে রেখেছে, কপালে একটা লাল টিপ, সুন্দর করে চুল বাধা।
দরজায় দাঁড়িয়ে নীল মুগ্ধ দৃষ্টিতে লিলটিকে দেখছে তো দেখছেই চোখ ফেরাতে পারছে না।
সকালে নীলের ফোনটা রিসিভ করার পর থেকেই নন্দিনীর মনে যেন বসন্তের ফুল ফুটলো, তখন থেকেই মনটা খুশিতে ঝলমল করছে, কত কত
দিন বাদে নীলকে কাছে থেকে দেখবে, একটু ছুঁয়ে ওর হারিয়ে যাওয়া অনুভূতি ফিরে পাবে আর ওর সেই ছেলেমানুষি গায়ের গন্ধ যেন লিলটি এখুনি পাচ্ছে। ইচ্ছে করছে আজ খুব সাজবে খুব সেজে আজ ও নীলের সামনে দাঁড়াবে। সকাল বেলাতেই স্নান করে নিল লিলটি, বেশি ড্রেস সংগে আনেনি, যা এনেছে তার থেকেই পিংক কালারের সালোয়ার কামিজটা পরে নিল। তার পর হোটেলের রুমের ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে খুব সুন্দর করে সাজলো, আজ ঠোঁটে লিপস্টিক না দিয়ে লিপগ্লস
লাগালো, ও জানে শুধু লিপগ্লস ওর ঠোঁট দুটোকে বেশী আকর্ষণীয় করে তোলে। বড়বড় ভ্রমর কালো চোখ দুটো তে ছুঁইয়ে নিলো একটু কাজল, আর কপালে একটা লাল টিপ। সারা শরীরে স্প্রে করে নিলো ওর নিজের ভালো লাগা পারফিউম।
ঠিক এগারোটা বাজার একটু পরেই লিলটি শুনতে পেলো ওর রুমের ডোর বেলটা বেজে উঠলো। লিলটির মনে হচ্ছে বেলের আওয়াজটা যেন কোন
সুদূরে হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের দেশ থেকে আসছে। আস্তে আস্তে গিয়ে চোখ বুজে রুমের দরজাটা খুলে দিলো আজকের নন্দিনী। চোখ বুজে দাঁড়িয়ে আছে নন্দিনী, শুনতে পেলো যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসা একটি ডাক... লিলটি.. দেখো আমি এসেছি। আস্তে আস্তে চোখ খুলল লিলটি। দেখে ওর দিকে তাকিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওর সেই কিশোরী মনের ভালোবাসা নীল।
নীলের দিকে তাকিয়ে থাকে লিলটি, দু চোখে এক রাশ মুগ্ধতা,কি দারুন লাগছে, ঝকঝকে স্মার্ট হ্যান্ডসাম ম্যান। পরনে দামি ব্লু কালারের সুট,নিখুঁত স্ট্রাইপ্ড টাই নিচে হোয়াইট সার্ট চোখে দামি গোল্ডেন ফ্রেমের চশমা। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে, এই মুহুর্তে ওদের দুজনের কাছে যেন বাকি পৃথিবীর আর কোনো অস্তিত্বই নেই। হটাত চমক ভেংগে লিলটি ঝাঁপিয়ে পড়ে নীলের বুকে, দু হাতে নীলকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে লিলটি আজকের নন্দিনী। নীল ও লিলটিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। এত দিনে নীলের মনে ছোট বেলার
দেখা একটা উত্তম কুমার আর সুচিত্রা সেনের সিনেমা পথে হলো দেরীর শেষ দৃশ্য, যেন ওর জীবনে বাস্তব রূপ পেলো, কিশোর বয়েসে লিলটিকে নিয়ে যে স্বপ্ন মনের মাঝে সযত্নে লালন
করে এসেছে। সে দিন নন্দিনীকে নিয়ে নীল লেদার ফেয়ার এ্যাটেন্ড করে ওর সাথেই দুপুরে লাঞ্চ করে সারাটা দিন কাটিয়েছিল।
পরের দিন সকালের রিটার্ন ফ্লাইট 6E304, নন্দিনী ফিরে গেলো কলকাতা।
নীলকে আরো দুটো দিন থাকতে হয়েছিল চেন্নাইতে, লেদার ফেয়ারের শিডিউল কম্পলিট করে নীলও ফিরে এলো কলকাতা। রাজারহাট নিউটাউনে অনেক দিন আগেই লিলটি ফ্ল্যাট
কিনে মাকে নিয়ে চলে এসেছিলো বেলেঘাটা থেকে।সপ্তাহে দুটো করে ফ্লাইট থাকে ডোমেস্টিক, চারটে দিন ডিউটিতেই কেটে যায়, বাকি তিন দিন রেষ্ট ডেজ। দুজনেই কলকাতাতে ফিরে আসার পর রোজই ফোনে কথা হয়,আর ছুটির দিন গুলো এক সাথে কাটায়, কখনো লং ড্রাইভ, কখনো মাঝ গঙ্গায় নৌকোতে বসে হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন গুলোকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা। মাঝে মাঝে সোজা ডায়মন্ড হারবারের সাগরিকা।সারাদিন সাগরিকার রুমে দুজনে দুজনেকে আদরে আদরে ভরিয়ে রাখা, আর প্ল্যান করা কবে দুটো জীবন এক হবে।
মাঝে মাঝে প্রচন্ড ঝগড়াও হোতো, কি নিয়ে? না ওদের প্রথম ছেলে হবে না মেয়ে হবে। নীল বলতো তোমার মত একটি ফুট ফুটে মেয়ে আমার চাই আগে, আর লিলটি খেপে গিয়ে বলতো মোটেই না আমি প্রথমেই তোমার মত একটি জুনিয়র নীল চাই। এই ভাবে খুশীতে খুনশুটিতে দিন কেটে যায়। এরই মধ্যে নন্দিনী ইন্ডিগো এয়ার লাইন্স চেঞ্জ করে জেট এয়ারওয়েজ এর ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটের সিনিওর এয়ার হোস্টেসের চাকরীতে জয়েন করেছে, এয়ার লাইন্স অফিসে নন্দিনী নিজের মোবাইল নাম্বারের সাথে নীলের ফোন নাম্বারটাও ব্যাক আপ দিয়েছে ফর এমার্জেন্সি। আপাতত নন্দিনী কে ডিউটির ফ্লাইট এভেইল করতে হয় মুম্বাই থেকে, মুম্বাই টু সিংগাপুর ৬ ঘণ্টার জার্নি
তাই ফ্লাইং ক্রু দের উইকলি দুটো করে ফ্লাইট ডিউটি পারফরম করতে হয়। মোটা মুটি নীল আর লিলটি ডিসাইড করে নিয়েছে বিয়ের পর নন্দিনী এয়ার হোস্টেসের চাকরী আর করবে না। আজ দুদিন হলো লিলটির মা বর্ধমানে মামার বাড়ি
গেছেন, লিলটি একাই ফ্লাটে আছে, খুব খুশি, কালকের ফ্লাইট ডিউটি টা কমপ্লিট হয়ে গেলেই, চাকরীটা ছেড়ে দেবে নন্দিনী।
ফিরে আসার এক সপ্তাহের মধ্যে ওর আর নীলের রেজিস্ট্রি ম্যারেজ হয়ে যাবে। অলরেডি নোটিস দেয়া হয়ে গেছে। কি যে ভালো লাগছে, হটাত মাথায় একটা দুষ্টুমি বুদ্ধি খেলে গেলো, আজ ও আর নীল দুজনে যদি একসাথে এক বিছানায়
সারা রাত আদরে আদরে কাটিয়ে দেয়, তাহলে কেমন হয়? আর সাত দিন বাদেইতো ওরা বিয়ে করে নিচ্ছে। ভাবতেই লিলটির গাটা কেমন কাঁটা দিয়ে উঠলো, বিছানায় কি হতে পারে ভাবতে গিয়ে নিজেই লজ্জা পেয়ে গেলো লিলটি। এবার যথা
চিন্তা তথা কাজ, নীলকে ফোনে বলে দিলো , আজ রাতে নীল ওর সাথে ওর ফ্ল্যাটে ডিনার করবে, আর আজ রাতে ঘরে ফেরা নৈব নৈব চ। সেদিন ঠিক আট টার সময় নীল পাজামা আর একটা কালারড পাঞ্জাবী পরে এসেছিল। কি সুন্দর লাগছি নীলকে। ডিনারের পর দুজনে এক পেগ কোরে হুইস্কি নিয়ে
গল্প করতে করতে রাত প্রায় বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল। নীল গ্লাসের শেষ সিপটা মেরে উঠে দাঁড়ালো, লিলটি এক দৃষ্টিতে নীলকে দেখছে আর মিটিমিটি করে হাসছে।নীল লিলটিকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে গেলো, ঘরের লাইট না নিভিয়ে আর একটা লাইট জ্বালিয়ে দিলো। নিজের হাতে গোলাপের কুঁড়ির পাপড়ি একটা একটা করে খুলে গোলাপটাকে পরিপূর্ণ করে ফুটিয়ে তুললো।
ঝক ঝকে আলোয় নীল মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে বিছানার ওপরে শুয়ে আছে এক সোনার বরণ রাজকন্যা। সে দিন সারা রাত ওদের দুজনের পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, শুধু এয়ার
কন্ডিশনারের গুন গুন শব্দ যেন ভ্রমর পাখার গুঞ্জন শুনিয়েছিল ওদের দুজনকে সারা রাত। শেষ রাতে পরিতৃপ্ত দুটো শরীর জড়িয়ে ধোরে ঘুমিয়ে পরেছিল।পরের দিন নন্দিনী এক সপ্তাহের জন্য চলে যাবে মুম্বাই থেকে সিংগাপুর, ওর এয়ার হোস্টেস জীবনের লাস্ট ফ্লাইট। নীল গিয়েছিল দমদম এয়ারপোর্টে লিলটিকে জেট এয়ার
লাইন্সের মুম্বাই এর ফ্লাইটে সি অফ করতে। এয়ারপোর্টের গেটে নীলকে জড়িয়ে ধরে লিলটি বলেছিল, নীল আজ তোমার ছোঁয়ায় ভালোবাসা কাকে বলে জেনে গেছি আর সারা জীবনের জন্য তোমাকে ভালোবাসবো, এখন তোমাকে ছেড়ে যেতে একটুও ইচ্ছে করছে না। কেন যেন এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি ফেরার সময় গাড়ীতে নীলের মনটা খুব খারাপ লাগছিল। কত দিনই তো লিলটিকে সি অফ করেছে নীল, কিন্তু কোনো দিন তো লিলটি এমন কথা বলে নি।
বুঝতে পারছে লিলটির শেষ কথা গুলো নীলের মনে একটা আশংকা দানা বেধে দিচ্ছে। নীল জানে মুম্বাই থেকে জেটএয়ার ওয়েজের উইকলি তিনটে ফ্লাইট, যে ফ্লাইটে নন্দিনী আজ হোস্টেস তার নাম্বার 9W12 from Mum To Sin। মনের মধ্যে
একটা অশান্তি নিয়ে নীল এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি ফিরে এলো।ঠিক রাত ৯ টার সময় নীল লিলটির ফোন পেলো, আমি অন বোর্ড, এখুনি আমরা টেক অফ করবো, এখন আর ফোন কোরো না, খুব শিগগির তোমার কাছে ফিরে আসবো, খুব খুব
ভালোবাসি তোমাকে নীল,আমার চুমু নাও, একটা চুমুর আওয়াজ শুনতে পেলো নীল।
অনেক রাতে হটাত মোবাইলের আওয়াজে নীলের ঘুম ভেঙ্গে গেলো, বিছানাতেই ঘড়ীতে দেখলো রাত তিনটে বাজে, কে ফোন করলো? মোবাইলে কল রিসিভ করতেই ইংরেজিতে কয়েকটা কথা শুনেতেই নীলের চোখের সামনে সারা পৃথিবীটা দুলে উঠলো। We are very sorry to inform you that flight number 9W12 of Jet airways from Mumbai to Singapore has been crashed on sea 110 notical Miles away from Malaysia. We have got your phone number from the record Of Nandini Sen in our system , Nandini Sen was in board as 1st air hostes in that flight.
Please contact Mumbai office.
কত গুলো বছর কেটে গেলো তার পর, নীল একাই থাকে বিয়ে করা আর হয়ে ওঠেনি, এক রাশ শুন্যতা চোখে নিয়ে রোজ রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে নীল আর কানে বাজে লিলটির শেষ কথা গুলো, নীল তোমার ছোঁয়ায় ভালোবাসা
কাকে বলে বুঝে গেছি, তোমাকে খুব ভালোবাসি, আজ তোমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।
*************