D
Deleted member 10999
Guest
রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন কবে?
শঙ্খ ঘোষ
রবিবারের বিকেলবেলায় স্কুলের মেসবাড়িতে বসে আছেন ইতিহাসের মাস্টারমশাই সুজয়বাবু। তাঁকে ঘিরে গল্পে মেতে আছে ক্লাস নাইন-টেনের কয়েকটি ছেলে। হঠাৎ সুজয়বাবু বলে বসলেন : ‘আর ক-দিন পরই না বিদ্যাসাগরের জন্মদিন?'
ক্লাস নাইনের নন্টু বলল : ‘হ্যাঁ তো।’
‘কবে বল্ তো?’
একটু ইতস্তত করছিল সবাই। খানিক ভেবে মাতব্বরের মতো ক্লাস টেনের রজত বলল : 'জানি, জানি। ছাব্বিশে সেপ্টেম্বর।' “ঠিক। আর নেতাজির ?'
এ-প্রশ্ন শুনে সবাই অবাক। সমস্বরে বলল সবাই : ‘কেন, তেইশে জানুয়ারি।'
‘রবীন্দ্রনাথ?’
‘এ কী হচ্ছে স্যার? এ তো যে-কোনো বাচ্চা ছেলেমেয়েও জানে।'
‘হ্যাঁ, জানি তো। তবু বল্ না একবার।' এতক্ষণে একটু যেন মজা পেয়ে গেছে সবাই। নুরুল বলল : ‘পঁচিশে
বৈশাখ।”
‘বিবেকানন্দ?’
‘বারোই জানুয়ারি।'
‘শ্রীঅরবিন্দটা জানিস?'
অনেক ভেবেচিন্তে একজন বলল : ‘বোধহয় পনেরোই আগস্ট। না?'
‘বিধানচন্দ্র রায়? এটা জানিস??
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এটা জানি। ওই-যে একই দিনে জন্মদিন আর মৃত্যুদিন। পয়লা জুলাই। কিন্তু এগুলো কী হচ্ছে স্যার? জন্মদিনের তালিকা মুখস্থ করাচ্ছেন?'
‘না, তা ঠিক নয়। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ কর্ তো। এতগুলি তারিখ বললি তোরা, শুধু রবীন্দ্রনাথেরটাই কেন বাংলা তারিখ। অন্যগুলিতে বাংলা নেই কেন?'
এবার একটু ধাঁধায় পড়ল সবাই। তবে দমবার পাত্র নয় রজত। সে বলল : ‘ওই-যে নিজের জন্মদিন নিয়েই গান লিখেছেন না? হে নূতন গানটার মধ্যেই আছে না— চিরনূতনেরে দিল ডাক/পঁচিশে বৈশাখ। তাই থেকেই—'
‘ঠিকই বলেছিস, সেটা একটা কারণ বটে। কিন্তু মুশকিল হলো, সে-গান তো একেবারে জীবনের শেষ বছরে লেখা। যদিও তার বেশ কিছু আগেকার লম্বা একটা কবিতাতেই ছিল ও-গানের আভাস। আর পঁচিশে বৈশাখ কথাটা কিন্তু তার আগে থেকেই চলছে।'
তখন সবাই ভেবে দেখার চেষ্টা করল অন্যগুলিকেও বাংলায় বলা যায় কিনা। কিন্তু ভালোরকম মনে পড়ছে না।
‘মনে পড়ছে না তো, তাহলে জেনে রাখ্ — জেনে রাখা ভালো বিধানচন্দ্র রায় আঠারোই আষাঢ়, অরবিন্দ বত্রিশে শ্রাবণ, বিবেকানন্দ ঊনত্রিশে পৌষ, নেতাজি এগারোই মাঘ আর বিদ্যাসাগর বারোই আশ্বিন।'
‘তার মানে ছাব্বিশে সেপ্টেম্বর হলো বারোই আশ্বিন? আজ বাংলার কত তারিখ?’
সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। বাংলা তারিখ তো খেয়াল থাকে না। চট্ করে একজন বাংলা কাগজটা তুলে দেখে নেয় সেদিনকার তারিখটা। তিরিশে ভাদ্র।
‘আজ ষোলোই সেপ্টেম্বর। তাহলে ছাব্বিশে সেপ্টেম্বর তো দশদিন পর? তাহলে তো দশ আশ্বিন হবে, বারোই কী করে হলো?”
‘দশ আশ্বিনও হবে না, হবে নয় আশ্বিন। ভাদ্রমাস তো তিরিশ দিনের নয়, ওটা একত্রিশ দিনে শেষ। সেই হিসেবে নয় আশ্বিন হবার কথা, কিন্তু সে তো ছিল ১৮২০ সালের ব্যাপার। এতদিনে একটু একটু করে পালটাতে। সৌটা বারোয় এসে পৌঁছেছে।'
তাহলে কি রবীন্দ্রনাথেরটাই খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডারমতে বলব? কী যেন তারিখটা?'
একজন : 'নয় মে।'
সুজয়বাবু বললেন : 'নয় মে? ঠিক তো?’
'ঠিক না? নয় মে ছিল না?'
'কী ছিল আর কী ছিল না তা নিয়ে পরে বলছি। এবার একটা গল্প বলি শোন্? বছর ছয়েক আগে তোরা যখন থ্রি-ফোরের ছাত্র, খুব ঘটা করে তখন রবীন্দ্রজন্মোৎসব হয়েছিল, মনে পড়ে একটুও?’ 'হ্যাঁ হ্যাঁ, খুবই মনে পড়ে, খুব আনন্দ হয়েছিল সে-বছর।'
`সেবার অত ঘটার কারণ ছিল— রবীন্দ্রনাথের জন্মের দেড়শো বছর পূর্ণ হলো। সেই উপলক্ষ্যে সেবার ভারত-বাংলাদেশ মিলিয়ে বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল। দুই দেশের একসঙ্গে উদযাপন, দুই দেশেরই বিস্তর তৎপরতা তাই নিয়ে। ভারত থেকে একটা সরকারি দল চলেছে ঢাকায়, বাংলাদেশের সরকারি মহলের সঙ্গে বৈঠকে। সরকারি সে-আয়োজনে সংস্কৃতি জগতের কয়েকজনকে তো থাকতেই হবে, তাই আমার এক বন্ধু রুদ্রাংশুও ছিল আটজনের সেই দলে। তার কাছে গল্প শুনেছি, মহাসমারোহের সে-বৈঠকে হঠাৎ একটা সংকট তৈরি হয়েছিল।'
‘সংকট? এ-নিয়েও সংকট?’
'হ্যাঁ, তবে ভয়ের কিছু নয়, মজার সংকট। বছরজোড়া অনেক কাজের সূচি তৈরি হয়ে গেছে দু-দেশের জন্যই, আর ঠিক হয়েছে পঁচিশে বৈশাখটা বিশেষভাবে উদযাপন করতে হবে, দিল্লি, ঢাকা আর কলকাতায়। দুই দেশের রাজধানী আর রবীন্দ্রনাথের রাজ্য। আর সেদিন এই তিনটি জায়গাতেই থাকতে হবে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী বা সরকারি স্তরের কোনো উচ্চমর্যাদার মানুষকে। সকলে তো একবাক্যে রাজি। কিন্তু একটু পরে। বাংলাদেশেরই একজন কৌতুক করে বললেন : “তবে তো সেটা ভৌতিক অবস্থান হবে। একই দিনে একইসঙ্গে তিন জায়গায় থাকবেন কী করে এঁরা?” কয়েক মিনিট সকলেই খুব ভাবিত হয়ে পড়লেন। রুদ্রাংশু তখন
গম্ভীরভাবে বলে : “একই দিনে তো নয়, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন তো তিনটে।” অন্যেরা চমকে উঠে বলে: “তার মানে? পঁচিশে বৈশাখ তিনটে?” রুদ্রাংশু বলে: “তিনদিন নয়? দিল্লিতে তো বাংলা ক্যালেন্ডার নেই। বাংলার বাইরে সব জায়গাতেই রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন তো সাতই মে। আর বাংলায় যে পঁচিশে বৈশাখ সেটা তো আজকাল পশ্চিমবঙ্গে সরতে সরতে নয় মে হয়ে গেছে। এদিকে পঞ্জিকা সংস্কারের পর বাংলাদেশে সেটা সবসময়ই থাকবে আটই মে। তাহলে দিল্লির অনুষ্ঠান সাত তারিখ, ঢাকার অনুষ্ঠান আট তারিখ, কলকাতার অনুষ্ঠান নয় তারিখ, তিনটেই হবে বিধিমতে পঁচিশে বৈশাখ।” সভায় একইসঙ্গে কৌতুকবোধ আর স্বস্তিবোধ হলো সকলের।
স্কুলের ছেলেরা গল্পটা শুনে মজাও পেল, আর একটু ধন্দেও পড়ল।
‘তার মানে তিনদিনই পঁচিশে বৈশাখ?? সুজয়বাবু গম্ভীর স্বরে বললেন : 'না, চারদিন।' আঁৎকে উঠল সবাই।
‘চারদিন? মানে?’
সুজয়বাবু বললেন : 'একটা ছবি তোরা কখনো দেখেছিস? গোলাপ ফুলের বিরাট মালা-গলায় বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ? পারস্যের তেহরান শহরে উদযাপন হচ্ছে তাঁর জন্মদিন, সেইদিনকার ছবি। সেখানে বসে রবীন্দ্রনাথ কী লিখছেন শোন্ :
আজ ৬ই মে। য়ুরোপীয় পঞ্জিকার মতে আজ আমার জন্মদিন। আমার পারসিক বন্ধুরা এই দিনের উপর সকালবেলা থেকে পুষ্পবৃষ্টি করছে। আমার চারিদিক ভরে গেছে বসন্তের ফুলে, বিশেষত গোলাপে।
এই বিশেষ দিনটাতে রবীন্দ্রনাথ চোদ্দ লাইনের একটি কবিতাও লিখেছিলেন যার প্রথম ক-টা লাইন ছিল
ইরান তোমার যত বুলবুল তোমার কাননে যত আছে ফুল
বিদেশী কবির জন্মদিনেরে মানি
শুনালো তাহারে অভিনন্দন বাণী।
গল্প শুনে সবাই থ। 'রবীন্দ্রনাথ নিজে লিখেছেন ৬ই মে?'
‘শুধু কি এখানেই লিখেছেন? ১৯১০ সালে একটা চিঠিতে “দি বেঙ্গলি" পত্রিকার সহ-সম্পাদক পদ্মিনীমোহন নিয়োগী নামে একজন জিজ্ঞাসুকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনতথ্য খানিকটা জানিয়েছিলেন। তার মধ্যেও স্পষ্টাক্ষরে লেখা ছিল: “আমার জন্মের তারিখ ৬ই মে ১৮৬১ খৃষ্টাব্দ।”
'কোথা থেকে এল এই ৬ই মে?’
'শোন্ তবে কোত্থেকে এল : যে-বছর রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন সে-বছর।
পঁচিশে বৈশাখ ছিল ৬ই মে।' ‘তাই? তাহলে দিল্লির সাতই মে-টা কোত্থেকে এল?’
‘শুধু দিল্লি নয়, গোটা পৃথিবীই জানে সাতই মে।
‘কেন জানে?’
‘কেন জানবে না? রবীন্দ্রনাথের জন্ম ছয় মে তারিখের রাত বারোটার পর, তাই খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডারমতে সেটা সাত তারিখ হয়ে যায়। এই হলো সমাধান আবার সেটাই হলো সমস্যা। ছয় মে সারাদিনরাতটাকেই আমরা বলি ছয় মে, সেদিন ছিল পঁচিশে বৈশাখ। সেই পঁচিশে বৈশাখের রাত বারোটার পর খ্রিষ্টীয় মতে সাত মে। আর বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সরতে সরতে এখানে এখন নয় মে আর বাংলাদেশে আট। পাওয়া গেল তো চার-চারটে দিন?’
‘কী মজা! এ তো প্রায় সপ্তমী-অষ্টমী-নবমী-দশমীর দুর্গাপুজো। করলেই হয় চারদিন ধরে।'
‘চারদিন ধরে না হলেও, তিনদিন ধরে কথাটা কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছিলেন একবার। ১৯৩৮ সালে কিশোরীমোহন সাঁতরাকে এই একটা চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ :
রোসো, আগে তোমার সঙ্গে জন্ম-তারিখের হিসেব-নিকেশ করা যাক। তুমি হলে হিসেবী মানুষ। যে বছরের ২৫শে বৈশাখে আমার জন্ম সে-বছরে ইংরেজি পাঁজি মেলাতে গেলে চোখে ঠেকবে ৬ই মে। কিন্তু ইংরেজের অদ্ভুত রীতি অনুসারে রাত দুপুরের পরে ওদের তারিখ বদল হয়, অতএব সেই গণনায় আমার জন্ম ৭ই। --তর্কের শেষ এখানেই নয়, গ্রহনক্ষত্রের চক্রান্তে বাংলা পাঁজির দিন ইংরেজি পাঁজির সঙ্গে তাল রেখে চলবে না-- ওরা প্রাগ্রসর জাত, পঁচিশে বৈশাখকে ডিঙিয়ে যাচ্ছে কয়েক বছর ধরে হল ৭ই, তার পরে দাঁড়িয়েছে ৮ই। তোমরা ওই তিন দিনই যদি আমাকে অর্ঘ্য নিবেদন কর, ফিরিয়ে দেব না, কোনোটাই বে-আইনী হবে। না। এ কথাটা মনে রেখো।
‘তাঁর কথা তো রেখেছি আমরা। দেড়শো বছরে তিনদিন জুড়ে অৰ্ঘ্য
দিয়েছি।'
‘কিন্তু স্যার, দেওয়া উচিত ছিল চারদিন ধরে, এখন তো দাঁড়িয়েছে নয়। তাহলে ছয়, সাত, আট,
নয় -- সপ্তমী-অষ্টমী-নবমী-দশমী!’
নুরুল হঠাৎ বলে : ‘আচ্ছা দুর্গাপুজো শুরু হয় কবে রে? ষষ্ঠীতে না? তাহলে আরেকটা দিন বাড়ালেও তো হয়।'
সবার হাসির অট্টরোলে মেতে গিয়ে সুজয়বাবু বললেন : ‘হ্যাঁ, তাও বলতে পারিস। মংপুর নাম শুনেছিস?’
শুনেছে প্রায় সবাই। দলের মধ্যে একজন ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ' পড়েওছে। সে বলল : 'সেই যেখানে বারে বারেই যেতেন রবীন্দ্রনাথ ?
‘হ্যাঁ, শেষবার গিয়েছিলেন ১৯৪০ সালে। গিয়েছিলেন সেবার এপ্রিলের শেষে। মৈত্রেয়ী দেবী বেশ ঘটা করে লিখেছেন “২৫শে বৈশাখ আসন্ন হয়ে এসেছে, আমরা ভাবছি কী করা যায়! এমন দিনে তিনি আমাদের কাছে আছেন, এ পরম দুর্লভ সৌভাগ্য তো বিনা উৎসবে ভোগ করা যায় না।” যায় না বলে যথাসাধ্য উৎসবের ব্যবস্থা হলো। রবীন্দ্রনাথ সেদিন সকাল দশটার সময় স্নান করে সেজেগুজে বাইরে এসে বসেছেন। বুদ্ধমূর্তির সামনে বসে একজন বৌদ্ধ বৃদ্ধ স্তোত্রপাঠ করলেন, দুপুর বেলায় জন্মদিন নিয়ে তিনটে কবিতা লিখলেন রবীন্দ্রনাথ। বিকেলে পাহাড়ি গরিব প্রতিবেশীরা দলে দলে আসতে লাগল। সানাই বাজতে লাগল। তিব্বতি আর ভুটানিরা তাদের নাচ দেখাল। সবাই সারি সারি বসে পাতার ঠোঙায় খাবার খেল। তদারকি করছেন রবীন্দ্রনাথ। খুব ঘটা করেই হলো তো ব্যাপারটা? কিন্তু কবে হলো? সেদিনটা ছিল পাঁচই মে। তাহলে তোদের ষষ্ঠী থেকে দশমী সবটাই হয়ে গেল।'
‘সবকটা তারিখের তো যুক্তি বোঝা গেল। পাঁচের যুক্তিটা কী?’
‘আর কোনো যুক্তি নেই। যুক্তি শুধু রবিবার। নির্জন পাহাড়ি জায়গায় অন্য কোনোদিনে আয়োজন করা বড়ো শক্ত হবে। তাই রবিবারেই হলো, পাঁচ তারিখ। কিন্তু সেদিন বসেই তো জন্মদিনের কবিতাগুলি লিখতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ?’
‘এ তো ভারি মজা।'
‘মজা তো আছে আরো। “সভ্যতার সংকট” নামের প্রবন্ধটার নাম শুনেছিস তো? বলা হয় সেটা পড়া হয়েছিল তাঁর শেষ জন্মোৎসবে। সে-উৎসবের দিনটা কবে ছিল বল্ তো?’
‘চার? চৌঠা মে? তাহলেই তো ষোলোকলা পূর্ণ।'
‘না, চৌঠা মে নয়। সেটা ছিল চোদ্দই এপ্রিল, পয়লা বৈশাখ।'
‘সে আবার কী? পয়লাটা হঠাৎ এল কোত্থেকে?’
‘একেবারে হঠাৎ নয়, খুব গরম পড়ে যেত বলে পঁচিশে বৈশাখের অনেক আগেই গ্রীষ্মের ছুটি হয়ে যেত শান্তিনিকেতনে নববর্ষের পরেই। আর তাই, ১৯৩৬ সাল থেকেই সেই জন্মোৎসব উদ্যাপন করার রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল পয়লা বৈশাখ।'
‘যাব্বাবা! তাহলে তো সবদিনই করা যাবে রবীন্দ্রজন্মোৎসব।'
‘ঠিক তাই। আমাদের কাছে তো যে-কোনো দিনই রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। অন্তত তাই তো হবার কথা। প্রতিদিনই তিনি জন্মাচ্ছেন না আমাদের মধ্যে নতুন নতুন করে? ধর্, রোজই যদি পড়িস বা মনে পড়ে তাঁর কোনো গান বা কবিতা বা নাটকের কোনো অংশ বা এমনকী গদ্যলেখার, হঠাৎ যেন মনে হতে পারে : আরে, আগে তো এটা এমনভাবে বুঝিনি বা ভাবিনি। মনে হতে পারে এ একটা নতুন আবিষ্কার। তখন এসব কথার স্রষ্টাকে মনে হতে পারে নিজের নিভৃত বন্ধুর মতো। সেই স্রষ্টাও তখন তোর মধ্যে নতুন এক বন্ধু পেয়ে যান। জীবনের একবারে শেষ ফাল্গুনে একটা কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন : “যেখানেই বন্ধু পাই সেখানেই নবজন্ম ঘটে।” লাইনটাকে একটু পালটে নিয়ে বলাও যায়, “যেদিনেই বন্ধু পাই সেদিনেই নবজন্ম ঘটে।” তাই রোজই আমাদের পড়ার মধ্য দিয়ে, আমাদের বোধের মধ্য দিয়ে নতুন নতুন জন্ম হতে পারে রবীন্দ্রনাথের। তাই আমাদের কাছে প্রতিদিনই। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন।'
২০১৭ শঙ্খ ঘোষ
শঙ্খ ঘোষ
রবিবারের বিকেলবেলায় স্কুলের মেসবাড়িতে বসে আছেন ইতিহাসের মাস্টারমশাই সুজয়বাবু। তাঁকে ঘিরে গল্পে মেতে আছে ক্লাস নাইন-টেনের কয়েকটি ছেলে। হঠাৎ সুজয়বাবু বলে বসলেন : ‘আর ক-দিন পরই না বিদ্যাসাগরের জন্মদিন?'
ক্লাস নাইনের নন্টু বলল : ‘হ্যাঁ তো।’
‘কবে বল্ তো?’
একটু ইতস্তত করছিল সবাই। খানিক ভেবে মাতব্বরের মতো ক্লাস টেনের রজত বলল : 'জানি, জানি। ছাব্বিশে সেপ্টেম্বর।' “ঠিক। আর নেতাজির ?'
এ-প্রশ্ন শুনে সবাই অবাক। সমস্বরে বলল সবাই : ‘কেন, তেইশে জানুয়ারি।'
‘রবীন্দ্রনাথ?’
‘এ কী হচ্ছে স্যার? এ তো যে-কোনো বাচ্চা ছেলেমেয়েও জানে।'
‘হ্যাঁ, জানি তো। তবু বল্ না একবার।' এতক্ষণে একটু যেন মজা পেয়ে গেছে সবাই। নুরুল বলল : ‘পঁচিশে
বৈশাখ।”
‘বিবেকানন্দ?’
‘বারোই জানুয়ারি।'
‘শ্রীঅরবিন্দটা জানিস?'
অনেক ভেবেচিন্তে একজন বলল : ‘বোধহয় পনেরোই আগস্ট। না?'
‘বিধানচন্দ্র রায়? এটা জানিস??
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এটা জানি। ওই-যে একই দিনে জন্মদিন আর মৃত্যুদিন। পয়লা জুলাই। কিন্তু এগুলো কী হচ্ছে স্যার? জন্মদিনের তালিকা মুখস্থ করাচ্ছেন?'
‘না, তা ঠিক নয়। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ কর্ তো। এতগুলি তারিখ বললি তোরা, শুধু রবীন্দ্রনাথেরটাই কেন বাংলা তারিখ। অন্যগুলিতে বাংলা নেই কেন?'
এবার একটু ধাঁধায় পড়ল সবাই। তবে দমবার পাত্র নয় রজত। সে বলল : ‘ওই-যে নিজের জন্মদিন নিয়েই গান লিখেছেন না? হে নূতন গানটার মধ্যেই আছে না— চিরনূতনেরে দিল ডাক/পঁচিশে বৈশাখ। তাই থেকেই—'
‘ঠিকই বলেছিস, সেটা একটা কারণ বটে। কিন্তু মুশকিল হলো, সে-গান তো একেবারে জীবনের শেষ বছরে লেখা। যদিও তার বেশ কিছু আগেকার লম্বা একটা কবিতাতেই ছিল ও-গানের আভাস। আর পঁচিশে বৈশাখ কথাটা কিন্তু তার আগে থেকেই চলছে।'
তখন সবাই ভেবে দেখার চেষ্টা করল অন্যগুলিকেও বাংলায় বলা যায় কিনা। কিন্তু ভালোরকম মনে পড়ছে না।
‘মনে পড়ছে না তো, তাহলে জেনে রাখ্ — জেনে রাখা ভালো বিধানচন্দ্র রায় আঠারোই আষাঢ়, অরবিন্দ বত্রিশে শ্রাবণ, বিবেকানন্দ ঊনত্রিশে পৌষ, নেতাজি এগারোই মাঘ আর বিদ্যাসাগর বারোই আশ্বিন।'
‘তার মানে ছাব্বিশে সেপ্টেম্বর হলো বারোই আশ্বিন? আজ বাংলার কত তারিখ?’
সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। বাংলা তারিখ তো খেয়াল থাকে না। চট্ করে একজন বাংলা কাগজটা তুলে দেখে নেয় সেদিনকার তারিখটা। তিরিশে ভাদ্র।
‘আজ ষোলোই সেপ্টেম্বর। তাহলে ছাব্বিশে সেপ্টেম্বর তো দশদিন পর? তাহলে তো দশ আশ্বিন হবে, বারোই কী করে হলো?”
‘দশ আশ্বিনও হবে না, হবে নয় আশ্বিন। ভাদ্রমাস তো তিরিশ দিনের নয়, ওটা একত্রিশ দিনে শেষ। সেই হিসেবে নয় আশ্বিন হবার কথা, কিন্তু সে তো ছিল ১৮২০ সালের ব্যাপার। এতদিনে একটু একটু করে পালটাতে। সৌটা বারোয় এসে পৌঁছেছে।'
তাহলে কি রবীন্দ্রনাথেরটাই খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডারমতে বলব? কী যেন তারিখটা?'
একজন : 'নয় মে।'
সুজয়বাবু বললেন : 'নয় মে? ঠিক তো?’
'ঠিক না? নয় মে ছিল না?'
'কী ছিল আর কী ছিল না তা নিয়ে পরে বলছি। এবার একটা গল্প বলি শোন্? বছর ছয়েক আগে তোরা যখন থ্রি-ফোরের ছাত্র, খুব ঘটা করে তখন রবীন্দ্রজন্মোৎসব হয়েছিল, মনে পড়ে একটুও?’ 'হ্যাঁ হ্যাঁ, খুবই মনে পড়ে, খুব আনন্দ হয়েছিল সে-বছর।'
`সেবার অত ঘটার কারণ ছিল— রবীন্দ্রনাথের জন্মের দেড়শো বছর পূর্ণ হলো। সেই উপলক্ষ্যে সেবার ভারত-বাংলাদেশ মিলিয়ে বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল। দুই দেশের একসঙ্গে উদযাপন, দুই দেশেরই বিস্তর তৎপরতা তাই নিয়ে। ভারত থেকে একটা সরকারি দল চলেছে ঢাকায়, বাংলাদেশের সরকারি মহলের সঙ্গে বৈঠকে। সরকারি সে-আয়োজনে সংস্কৃতি জগতের কয়েকজনকে তো থাকতেই হবে, তাই আমার এক বন্ধু রুদ্রাংশুও ছিল আটজনের সেই দলে। তার কাছে গল্প শুনেছি, মহাসমারোহের সে-বৈঠকে হঠাৎ একটা সংকট তৈরি হয়েছিল।'
‘সংকট? এ-নিয়েও সংকট?’
'হ্যাঁ, তবে ভয়ের কিছু নয়, মজার সংকট। বছরজোড়া অনেক কাজের সূচি তৈরি হয়ে গেছে দু-দেশের জন্যই, আর ঠিক হয়েছে পঁচিশে বৈশাখটা বিশেষভাবে উদযাপন করতে হবে, দিল্লি, ঢাকা আর কলকাতায়। দুই দেশের রাজধানী আর রবীন্দ্রনাথের রাজ্য। আর সেদিন এই তিনটি জায়গাতেই থাকতে হবে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী বা সরকারি স্তরের কোনো উচ্চমর্যাদার মানুষকে। সকলে তো একবাক্যে রাজি। কিন্তু একটু পরে। বাংলাদেশেরই একজন কৌতুক করে বললেন : “তবে তো সেটা ভৌতিক অবস্থান হবে। একই দিনে একইসঙ্গে তিন জায়গায় থাকবেন কী করে এঁরা?” কয়েক মিনিট সকলেই খুব ভাবিত হয়ে পড়লেন। রুদ্রাংশু তখন
গম্ভীরভাবে বলে : “একই দিনে তো নয়, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন তো তিনটে।” অন্যেরা চমকে উঠে বলে: “তার মানে? পঁচিশে বৈশাখ তিনটে?” রুদ্রাংশু বলে: “তিনদিন নয়? দিল্লিতে তো বাংলা ক্যালেন্ডার নেই। বাংলার বাইরে সব জায়গাতেই রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন তো সাতই মে। আর বাংলায় যে পঁচিশে বৈশাখ সেটা তো আজকাল পশ্চিমবঙ্গে সরতে সরতে নয় মে হয়ে গেছে। এদিকে পঞ্জিকা সংস্কারের পর বাংলাদেশে সেটা সবসময়ই থাকবে আটই মে। তাহলে দিল্লির অনুষ্ঠান সাত তারিখ, ঢাকার অনুষ্ঠান আট তারিখ, কলকাতার অনুষ্ঠান নয় তারিখ, তিনটেই হবে বিধিমতে পঁচিশে বৈশাখ।” সভায় একইসঙ্গে কৌতুকবোধ আর স্বস্তিবোধ হলো সকলের।
স্কুলের ছেলেরা গল্পটা শুনে মজাও পেল, আর একটু ধন্দেও পড়ল।
‘তার মানে তিনদিনই পঁচিশে বৈশাখ?? সুজয়বাবু গম্ভীর স্বরে বললেন : 'না, চারদিন।' আঁৎকে উঠল সবাই।
‘চারদিন? মানে?’
সুজয়বাবু বললেন : 'একটা ছবি তোরা কখনো দেখেছিস? গোলাপ ফুলের বিরাট মালা-গলায় বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ? পারস্যের তেহরান শহরে উদযাপন হচ্ছে তাঁর জন্মদিন, সেইদিনকার ছবি। সেখানে বসে রবীন্দ্রনাথ কী লিখছেন শোন্ :
আজ ৬ই মে। য়ুরোপীয় পঞ্জিকার মতে আজ আমার জন্মদিন। আমার পারসিক বন্ধুরা এই দিনের উপর সকালবেলা থেকে পুষ্পবৃষ্টি করছে। আমার চারিদিক ভরে গেছে বসন্তের ফুলে, বিশেষত গোলাপে।
এই বিশেষ দিনটাতে রবীন্দ্রনাথ চোদ্দ লাইনের একটি কবিতাও লিখেছিলেন যার প্রথম ক-টা লাইন ছিল
ইরান তোমার যত বুলবুল তোমার কাননে যত আছে ফুল
বিদেশী কবির জন্মদিনেরে মানি
শুনালো তাহারে অভিনন্দন বাণী।
গল্প শুনে সবাই থ। 'রবীন্দ্রনাথ নিজে লিখেছেন ৬ই মে?'
‘শুধু কি এখানেই লিখেছেন? ১৯১০ সালে একটা চিঠিতে “দি বেঙ্গলি" পত্রিকার সহ-সম্পাদক পদ্মিনীমোহন নিয়োগী নামে একজন জিজ্ঞাসুকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনতথ্য খানিকটা জানিয়েছিলেন। তার মধ্যেও স্পষ্টাক্ষরে লেখা ছিল: “আমার জন্মের তারিখ ৬ই মে ১৮৬১ খৃষ্টাব্দ।”
'কোথা থেকে এল এই ৬ই মে?’
'শোন্ তবে কোত্থেকে এল : যে-বছর রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন সে-বছর।
পঁচিশে বৈশাখ ছিল ৬ই মে।' ‘তাই? তাহলে দিল্লির সাতই মে-টা কোত্থেকে এল?’
‘শুধু দিল্লি নয়, গোটা পৃথিবীই জানে সাতই মে।
‘কেন জানে?’
‘কেন জানবে না? রবীন্দ্রনাথের জন্ম ছয় মে তারিখের রাত বারোটার পর, তাই খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডারমতে সেটা সাত তারিখ হয়ে যায়। এই হলো সমাধান আবার সেটাই হলো সমস্যা। ছয় মে সারাদিনরাতটাকেই আমরা বলি ছয় মে, সেদিন ছিল পঁচিশে বৈশাখ। সেই পঁচিশে বৈশাখের রাত বারোটার পর খ্রিষ্টীয় মতে সাত মে। আর বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সরতে সরতে এখানে এখন নয় মে আর বাংলাদেশে আট। পাওয়া গেল তো চার-চারটে দিন?’
‘কী মজা! এ তো প্রায় সপ্তমী-অষ্টমী-নবমী-দশমীর দুর্গাপুজো। করলেই হয় চারদিন ধরে।'
‘চারদিন ধরে না হলেও, তিনদিন ধরে কথাটা কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছিলেন একবার। ১৯৩৮ সালে কিশোরীমোহন সাঁতরাকে এই একটা চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ :
রোসো, আগে তোমার সঙ্গে জন্ম-তারিখের হিসেব-নিকেশ করা যাক। তুমি হলে হিসেবী মানুষ। যে বছরের ২৫শে বৈশাখে আমার জন্ম সে-বছরে ইংরেজি পাঁজি মেলাতে গেলে চোখে ঠেকবে ৬ই মে। কিন্তু ইংরেজের অদ্ভুত রীতি অনুসারে রাত দুপুরের পরে ওদের তারিখ বদল হয়, অতএব সেই গণনায় আমার জন্ম ৭ই। --তর্কের শেষ এখানেই নয়, গ্রহনক্ষত্রের চক্রান্তে বাংলা পাঁজির দিন ইংরেজি পাঁজির সঙ্গে তাল রেখে চলবে না-- ওরা প্রাগ্রসর জাত, পঁচিশে বৈশাখকে ডিঙিয়ে যাচ্ছে কয়েক বছর ধরে হল ৭ই, তার পরে দাঁড়িয়েছে ৮ই। তোমরা ওই তিন দিনই যদি আমাকে অর্ঘ্য নিবেদন কর, ফিরিয়ে দেব না, কোনোটাই বে-আইনী হবে। না। এ কথাটা মনে রেখো।
‘তাঁর কথা তো রেখেছি আমরা। দেড়শো বছরে তিনদিন জুড়ে অৰ্ঘ্য
দিয়েছি।'
‘কিন্তু স্যার, দেওয়া উচিত ছিল চারদিন ধরে, এখন তো দাঁড়িয়েছে নয়। তাহলে ছয়, সাত, আট,
নয় -- সপ্তমী-অষ্টমী-নবমী-দশমী!’
নুরুল হঠাৎ বলে : ‘আচ্ছা দুর্গাপুজো শুরু হয় কবে রে? ষষ্ঠীতে না? তাহলে আরেকটা দিন বাড়ালেও তো হয়।'
সবার হাসির অট্টরোলে মেতে গিয়ে সুজয়বাবু বললেন : ‘হ্যাঁ, তাও বলতে পারিস। মংপুর নাম শুনেছিস?’
শুনেছে প্রায় সবাই। দলের মধ্যে একজন ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ' পড়েওছে। সে বলল : 'সেই যেখানে বারে বারেই যেতেন রবীন্দ্রনাথ ?
‘হ্যাঁ, শেষবার গিয়েছিলেন ১৯৪০ সালে। গিয়েছিলেন সেবার এপ্রিলের শেষে। মৈত্রেয়ী দেবী বেশ ঘটা করে লিখেছেন “২৫শে বৈশাখ আসন্ন হয়ে এসেছে, আমরা ভাবছি কী করা যায়! এমন দিনে তিনি আমাদের কাছে আছেন, এ পরম দুর্লভ সৌভাগ্য তো বিনা উৎসবে ভোগ করা যায় না।” যায় না বলে যথাসাধ্য উৎসবের ব্যবস্থা হলো। রবীন্দ্রনাথ সেদিন সকাল দশটার সময় স্নান করে সেজেগুজে বাইরে এসে বসেছেন। বুদ্ধমূর্তির সামনে বসে একজন বৌদ্ধ বৃদ্ধ স্তোত্রপাঠ করলেন, দুপুর বেলায় জন্মদিন নিয়ে তিনটে কবিতা লিখলেন রবীন্দ্রনাথ। বিকেলে পাহাড়ি গরিব প্রতিবেশীরা দলে দলে আসতে লাগল। সানাই বাজতে লাগল। তিব্বতি আর ভুটানিরা তাদের নাচ দেখাল। সবাই সারি সারি বসে পাতার ঠোঙায় খাবার খেল। তদারকি করছেন রবীন্দ্রনাথ। খুব ঘটা করেই হলো তো ব্যাপারটা? কিন্তু কবে হলো? সেদিনটা ছিল পাঁচই মে। তাহলে তোদের ষষ্ঠী থেকে দশমী সবটাই হয়ে গেল।'
‘সবকটা তারিখের তো যুক্তি বোঝা গেল। পাঁচের যুক্তিটা কী?’
‘আর কোনো যুক্তি নেই। যুক্তি শুধু রবিবার। নির্জন পাহাড়ি জায়গায় অন্য কোনোদিনে আয়োজন করা বড়ো শক্ত হবে। তাই রবিবারেই হলো, পাঁচ তারিখ। কিন্তু সেদিন বসেই তো জন্মদিনের কবিতাগুলি লিখতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ?’
‘এ তো ভারি মজা।'
‘মজা তো আছে আরো। “সভ্যতার সংকট” নামের প্রবন্ধটার নাম শুনেছিস তো? বলা হয় সেটা পড়া হয়েছিল তাঁর শেষ জন্মোৎসবে। সে-উৎসবের দিনটা কবে ছিল বল্ তো?’
‘চার? চৌঠা মে? তাহলেই তো ষোলোকলা পূর্ণ।'
‘না, চৌঠা মে নয়। সেটা ছিল চোদ্দই এপ্রিল, পয়লা বৈশাখ।'
‘সে আবার কী? পয়লাটা হঠাৎ এল কোত্থেকে?’
‘একেবারে হঠাৎ নয়, খুব গরম পড়ে যেত বলে পঁচিশে বৈশাখের অনেক আগেই গ্রীষ্মের ছুটি হয়ে যেত শান্তিনিকেতনে নববর্ষের পরেই। আর তাই, ১৯৩৬ সাল থেকেই সেই জন্মোৎসব উদ্যাপন করার রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল পয়লা বৈশাখ।'
‘যাব্বাবা! তাহলে তো সবদিনই করা যাবে রবীন্দ্রজন্মোৎসব।'
‘ঠিক তাই। আমাদের কাছে তো যে-কোনো দিনই রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। অন্তত তাই তো হবার কথা। প্রতিদিনই তিনি জন্মাচ্ছেন না আমাদের মধ্যে নতুন নতুন করে? ধর্, রোজই যদি পড়িস বা মনে পড়ে তাঁর কোনো গান বা কবিতা বা নাটকের কোনো অংশ বা এমনকী গদ্যলেখার, হঠাৎ যেন মনে হতে পারে : আরে, আগে তো এটা এমনভাবে বুঝিনি বা ভাবিনি। মনে হতে পারে এ একটা নতুন আবিষ্কার। তখন এসব কথার স্রষ্টাকে মনে হতে পারে নিজের নিভৃত বন্ধুর মতো। সেই স্রষ্টাও তখন তোর মধ্যে নতুন এক বন্ধু পেয়ে যান। জীবনের একবারে শেষ ফাল্গুনে একটা কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন : “যেখানেই বন্ধু পাই সেখানেই নবজন্ম ঘটে।” লাইনটাকে একটু পালটে নিয়ে বলাও যায়, “যেদিনেই বন্ধু পাই সেদিনেই নবজন্ম ঘটে।” তাই রোজই আমাদের পড়ার মধ্য দিয়ে, আমাদের বোধের মধ্য দিয়ে নতুন নতুন জন্ম হতে পারে রবীন্দ্রনাথের। তাই আমাদের কাছে প্রতিদিনই। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন।'
২০১৭ শঙ্খ ঘোষ