Intrigued Individual
Newbie
আবেশ সামনে ল্যাপটপটা খুলে স্ট্যাচুর মতন বসে আছে। আজ আকাশটা মেঘলা, বৃষ্টি খানিক আগে ঝমঝমিয়ে হয়েছে, গায়ে রেইনকোট থাকা স্বত্তেও আবেশ বাইক চালিয়ে বাড়ি ফিরে দ্যাখে জামা আর প্যান্ট কিছুটা হলেও ভিজেছে। শাওয়ারের তলায় তাই নিজেকে পরিপূর্নভাবে ভিজিয়ে নিতে নিতে তাই আধভেজা থেকে ফুল ভেজার প্রক্রিয়াটা সেরে নিচ্ছিল। আর ভাবছিলো ও কি সত্যিই কিছু লিখবে বা কোনো পড কাস্টে আমন্ত্রিত হয়ে ও কি সত্যিই এই গত কাল ঘটে যাওয়া ঘটনাটা শেয়ার করবে হোস্টের সাথে? সেই ভাবনার জাল ছিঁড়তে পারেনি এখনো আবেশ!
আবেশ রায় একজন পেশাদার ঘোস্ট বাস্টার বা বাংলা মতে ওঝা। তার বেকবাগানের মর্ডান ফ্ল্যাটের সব প্রতিবেশিই প্রায় হয় ইঞ্জিনিয়ার নয় ব্যবসাদার বা উকিল কিম্বা তথাকথিত চেনাজানা পেশার সাথেই যুক্ত। কলকাতার মতন আধুনিক শহরের মেইন এলাকায় এতজন মানুষের মাঝে একজন ওঝা বাস করে, এ ব্যাপারটা শুনতে সত্যিই আজব লাগে। আর সত্যি বলতে কি আবেশ নিজেও আজও অনেকটাই অবাক হয় নিজের এই অদ্ভুত পেশার কথা ভেবে। আর দশটা পাঁচটা বন্ধুর মতন আবেশের কেরিয়ারটাও তো অনেকটাই চেনা ছকে বাঁধা ছিল। কলকাতারই এক কমার্স কলেজ থেকে পাশ করে আবেশ কিছু সরকারি চাকরির জন্যে আদাজল খেয়ে লেগে পড়েছিল প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করবে বলে। ভাগ্যচক্ত্রেই হোক বা নিজের অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্যেই হোক আবেশ সফলই হয়েছিল বলা যায়। এক রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে জুনিয়ার আ্যকাউন্টেন্টের একটা চাকরি সে পায়। ফলে ভেবেছিল এই বেশ, এভাবেই জীবনটা চেনা খাতেই বয়ে যাক। কিন্তু ওই- মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক! আবেশের সাথে কতকটা এমনই হয়েছিল।
আবেশ বড় হয়েছে এক বড় পরিবারে। এক জ্যাঠা আর আরেক কাকা, কাকীমা, খুড়তুতো ভাই। তবে পরিবারে আক্ষেপ ছিল তার বাবা আর কাকাদের। তিন ভাইয়ের কারোরই মেয়ে হয়নি। জ্যাঠার এক ছেলে, আবেশপ ওর বাবা আর মায়ের একমাত্র সন্তান, কাকার এক ছেলে। বয়েসে আবেশই সবার থেকে বড়। জ্যাঠা আর কাকারা অনেক বেশি বয়েসে বিয়ে করায় তাদের ছেলেরা আবেশের পরেই জন্মেছে। আবেশ নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করতো এমন এক যৌথ পরিবারে জমাতে পেরে।
আবেশ চাকরি পাওয়ার এক বছরের মাথায় প্ল্যান হলো পুরো পরিবার মিলে নৈনিতাল বেড়াতে যাওয়ার। আসলে আবেশ চাকরি পাওয়ার আগে বহু বছরই কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। আর সেই ঘুরতে যাওয়াই আবেশের জীবনে ডেকে এনেছিল এক মর্মান্তিক অভিশাপ। ওরা দুটো সুমো ভাড়া করে নৈনিতালের হোটেলে যাচ্ছিল। এঁকাবেঁকা পাহাড়ি গিরিপথ, সময়টা ছিল সেপ্টেম্বর মাস। ঘটনাটা ঘটে এত আকষ্মিকভাবে যে আজও আবেশ চোখ বুজলে শিউরে ওঠে।
সেদিনও খুব বৃষ্টি হচ্ছিল, পাহাড়ি রাস্তার উপর দিয়ে মাঝে মাঝে নেমে আসছিলো অনামি পার্বত্য ঝর্ণা। সেপ্টেম্বরেও তাই একটা ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া। আবেশের খুব জোরে হিসি পায়। ড্রাইভারকে বলে গাড়ি থামানো হয়। ওর গাড়িটাই আগে ছিল, ওটায় ছিল ও ওর বাবা, মা, আর জেঠ্যার ছেলে। আর পিছনেরটায় কাকাদের গোটা,পরিবার। যেখানটায় থামলো গাড়ি সেখানে রাস্তার এক পাশে খাদ আর অন্য পাশে খাঁড়া পাহাড়। রাস্তাটা পাহাড়টাকে কিছুটা কেটেই যেন পাহাড়ের পেটে ঢুকে গেছে অর্ধেকটা।
আবেশ দুটো গাড়িকে পিছনে রেখে কিছুটা এগিয়ে ওই ছাতার মতন পাহাড়ের তলায় পৌঁছাতেই এক বাজ পড়ার মতন শব্দ শুনে চমকে পিছনে তাকাতেই চোখের সামনে মুহুর্তের মধ্যে যা ঘটলো তা দেখে ও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল,,পা দুটোকে যেন পাথুরে রাস্তাটা কামড়ে ধরে স্থির করে দিয়েছিল। প্রায় সাত আটটা দৈত্যাকার আকারের কালান্তক যমের মতন পাথর বা বোল্ডার, চোখের নিমেষে পাহাড় থেকে উল্কার মতন ধেয়ে এসে রাস্তার সাইডে দাঁড় করা গাড়ি দুটোর উপরে পড়লো। কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার, গাড়িতে বসা মানুষগুলো গান শুনছিলো, কেবল হয়তো ঘাড় টুকু ঘোরাতে পেরেছিল ওরাও। তারপর? গাড়ি দুটো দুমড়ে মুচড়ে চ্যাপ্টা হয়ে গেল, সেই সাথে গাড়ির মানুষগুলোও! এক লহমায় আবেশ অনাথ হয়ে গেল সেই ক্ষণিকের আতঙ্কময় দুর্ঘটনায়। শোকে পাথর আবেশ ওই স্পটেই জ্ঞ্যাণ হারিয়ে রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল।জ্ঞ্যাণ ফিরতে ও নিজেকে এক সরকারি হাসপাতালের বেডে খুঁজে পেয়েছিল। কারা কিভাবে ওকে নিয়ে এসেছিল, সেসব আরেক ইতিহাস। আবেশ ফিরে এসে বারুইপুরের বসদ ভিটে, সম্পত্তি সবই বেচে দিয়েছিল প্রায় জলের দরেই বলতে গেলে, জীবন তার ছারখার হয়ে গিয়েছিল। ওখানে থাকা ছিল তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল। সেই টাকায় আবেশ বেকবাগানে ছোট্ট দুই কামরার এক ফ্ল্যাট কিনে বাকি টাকা ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিট করে। উত্তরাধিকার সূত্রে যা পেয়েছিল তা জলের দরে বেচেও আবেশের হাতে টাকাকড়ি বিস্তরই এসেছিল। কিন্তু সেসবে কি মানুষের মন ভোলে? এমন ঘটনার পরে কোন মানুষটা শান্তিতে দিন কাটাতে পারে? আবেশ হাজার চেষ্টা করেও নিজেকে সামলাতে পারছিলো না। অনেক মনোবিদ, অনেক চিকিৎসকের কাছে গিয়েও আবেশ নিজেকে উদ্ভ্রান্ত হিসেবেই খুঁজে পাচ্ছিল। এক অদ্ভুত অপরাধবোধ আবেশকে কুরে কুরে খাচ্ছিল, খালি মনে হতো এই চরম দুর্ঘটনার জন্যে সেই দায়ী। এরকম অবস্থায় হঠাৎ এক বন্ধুর পরামর্শে এক প্রকার নিমরাজি হয়েই আবেশ পৌঁছেছিল এক তান্ত্রিকের আড্ডায়। আসলে আবেশ এসব তন্ত্র মন্ত্রকে স্রেফ বুজরুকি আর মানুষ ঠকানোর ফন্দি হিসেবেই ভাবতো। ফলে যখন সে গিয়ে পৌঁছালো অবশেষে সিদ্ধ তান্ত্রিক আচার্য অশোক চাটুজ্যের চেম্বারে, তখন তার চেতনা জুড়ে এক রাশ বিরক্তি।
নিরস বদনে সামনে তাকিয়ে সেদিন সে দেখতে পেয়েছিল তার জীবনে আসা এক অসাধারণ মানুষকে প্রথমবার। খুবই সাধারণ বেশভূষা মানুষটার, জটা জুটো ধারী একটা ইমেজ আবেশের মাথায় ছিল। এ মানুষ তার ধারে কাছেই নেই। স্মিত হেসে প্রৌড়ত্ব পার করে বার্ধক্যের চৌকাঠে পা রাখা সৌম্য দর্শন মানুষটা প্রথমেই বলেছিল এক অদ্ভুত কথা- এসো, বসো। চা আর বিস্কিট দিতে বলেছি, সাথে অল্প তেলেভাজা। খাওয়াদাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছো তুমি। ওগুলো খেয়্র তারপর বাড়ি চলে যাও। আজ ঠিক করে তুমি স্বপ্নটা দ্যখার জন্যে প্রস্তুত নও।
আবেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল - স্বপ্ন? মানে? খামোকা স্বপ্ন দেখতে যাবো কেন? আমি কি এখাবে শুতে এসেছি নাকি? কাউন্সেলিং বোঝেন? সেটা যদি পারেন কিছু তো করুন, অনেক বড় হেল্প হবে। নয়তো মাফ করবেন, ওসব তেলেভাজা আর চায়ে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। আর হ্যাঁ আপনার ফিজটা আমি বরং এখনই দিই, সেটা দরকারী, চেম্বারে ঢোকার মুখেও দেখলাম লেখা আছে, প্রথম ভিজিটে আপনি ২৫০০ টাকা নিয়ে থাকেন। আসুন, আপনার ফিজ।
আবার আকর্ণ হেসে বলেছিলেন অশোকবাবু - টাকা আমি নেবোনা। আজও না, কালও নয়, কখনোই নয়। তবে তোমায় কথা দিতে হবে আজ খেয়েদেয়ে পরশু শুক্লা ত্রয়োদশীতে তুমি আমার চেম্বারে আর একবার আসবে। তারপরের ব্যাপার পরেই দ্যাখা যাবে।
অশোকবাবু সত্যিই কথা রেখেছিলেন আর আবেশও এই পিতৃপ্রতিম মানুষটার আন্তরিক অনুরোধে কোনো খাদ পায়নি। আবেশ এসেছিল পরেরদিন। অশোকবাবু আবেশকে চেম্বারের ইজি চেয়ারে শুইয়ে আবেশকে হয়তো সম্মোহিতই করেছিল। আবেশের গায়ে কাঁটা দেয় আজও সেদিনের কথা ভাবলে। স্বপ্নের ঘোরে আবেশ পৌঁছে গিয়েছিল সেই পাহাড়ি রাস্তাটার কাছে, কেবল চারিদিক ফাঁকা, গাড়িঘোড়া কিচ্ছু নেই, কেবল আবেশের পরিভার ছিল, ওদেরকে আবেশ দেখতে পেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল। তারপর ওরা আবেশকে বলেছিল ও যেন ওদেরকে কখনো না ভোলে আর জীবনকে ওদেরই মুখ চেয়ে নষ্ট না হতে দেয়। আর মা মাথায় হাত রেখে বলেছিল- তোর ভালো হবে, খুঁটি পেয়েছিস একটা, ধরে রাখ শক্ত করে, তাহলে আর ভেসে যাবিনা! চোখ খুলে সামনে অশোকবাবুকে দেখতে পেয়ে ও অশ্যকবাবুকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতন বহুক্ষন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল। আর অশোকবাবু অপার অপত্যস্নেহে আবেশের মাথায়, পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলেছিলেন- কেঁদে নাও খুঁটিটা ধরে, এরপর তোমার অনেক কাজ। আমি তোমায় কেবল পথ দ্যাখাবো, হাঁটতে কিন্তু তোমাকেই হবে, একা একা। তুমি শক্ত হও, তবেই সে সফর সম্ভব।
আবেশ রায় একজন পেশাদার ঘোস্ট বাস্টার বা বাংলা মতে ওঝা। তার বেকবাগানের মর্ডান ফ্ল্যাটের সব প্রতিবেশিই প্রায় হয় ইঞ্জিনিয়ার নয় ব্যবসাদার বা উকিল কিম্বা তথাকথিত চেনাজানা পেশার সাথেই যুক্ত। কলকাতার মতন আধুনিক শহরের মেইন এলাকায় এতজন মানুষের মাঝে একজন ওঝা বাস করে, এ ব্যাপারটা শুনতে সত্যিই আজব লাগে। আর সত্যি বলতে কি আবেশ নিজেও আজও অনেকটাই অবাক হয় নিজের এই অদ্ভুত পেশার কথা ভেবে। আর দশটা পাঁচটা বন্ধুর মতন আবেশের কেরিয়ারটাও তো অনেকটাই চেনা ছকে বাঁধা ছিল। কলকাতারই এক কমার্স কলেজ থেকে পাশ করে আবেশ কিছু সরকারি চাকরির জন্যে আদাজল খেয়ে লেগে পড়েছিল প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করবে বলে। ভাগ্যচক্ত্রেই হোক বা নিজের অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্যেই হোক আবেশ সফলই হয়েছিল বলা যায়। এক রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে জুনিয়ার আ্যকাউন্টেন্টের একটা চাকরি সে পায়। ফলে ভেবেছিল এই বেশ, এভাবেই জীবনটা চেনা খাতেই বয়ে যাক। কিন্তু ওই- মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক! আবেশের সাথে কতকটা এমনই হয়েছিল।
আবেশ বড় হয়েছে এক বড় পরিবারে। এক জ্যাঠা আর আরেক কাকা, কাকীমা, খুড়তুতো ভাই। তবে পরিবারে আক্ষেপ ছিল তার বাবা আর কাকাদের। তিন ভাইয়ের কারোরই মেয়ে হয়নি। জ্যাঠার এক ছেলে, আবেশপ ওর বাবা আর মায়ের একমাত্র সন্তান, কাকার এক ছেলে। বয়েসে আবেশই সবার থেকে বড়। জ্যাঠা আর কাকারা অনেক বেশি বয়েসে বিয়ে করায় তাদের ছেলেরা আবেশের পরেই জন্মেছে। আবেশ নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করতো এমন এক যৌথ পরিবারে জমাতে পেরে।
আবেশ চাকরি পাওয়ার এক বছরের মাথায় প্ল্যান হলো পুরো পরিবার মিলে নৈনিতাল বেড়াতে যাওয়ার। আসলে আবেশ চাকরি পাওয়ার আগে বহু বছরই কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। আর সেই ঘুরতে যাওয়াই আবেশের জীবনে ডেকে এনেছিল এক মর্মান্তিক অভিশাপ। ওরা দুটো সুমো ভাড়া করে নৈনিতালের হোটেলে যাচ্ছিল। এঁকাবেঁকা পাহাড়ি গিরিপথ, সময়টা ছিল সেপ্টেম্বর মাস। ঘটনাটা ঘটে এত আকষ্মিকভাবে যে আজও আবেশ চোখ বুজলে শিউরে ওঠে।
সেদিনও খুব বৃষ্টি হচ্ছিল, পাহাড়ি রাস্তার উপর দিয়ে মাঝে মাঝে নেমে আসছিলো অনামি পার্বত্য ঝর্ণা। সেপ্টেম্বরেও তাই একটা ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া। আবেশের খুব জোরে হিসি পায়। ড্রাইভারকে বলে গাড়ি থামানো হয়। ওর গাড়িটাই আগে ছিল, ওটায় ছিল ও ওর বাবা, মা, আর জেঠ্যার ছেলে। আর পিছনেরটায় কাকাদের গোটা,পরিবার। যেখানটায় থামলো গাড়ি সেখানে রাস্তার এক পাশে খাদ আর অন্য পাশে খাঁড়া পাহাড়। রাস্তাটা পাহাড়টাকে কিছুটা কেটেই যেন পাহাড়ের পেটে ঢুকে গেছে অর্ধেকটা।
আবেশ দুটো গাড়িকে পিছনে রেখে কিছুটা এগিয়ে ওই ছাতার মতন পাহাড়ের তলায় পৌঁছাতেই এক বাজ পড়ার মতন শব্দ শুনে চমকে পিছনে তাকাতেই চোখের সামনে মুহুর্তের মধ্যে যা ঘটলো তা দেখে ও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল,,পা দুটোকে যেন পাথুরে রাস্তাটা কামড়ে ধরে স্থির করে দিয়েছিল। প্রায় সাত আটটা দৈত্যাকার আকারের কালান্তক যমের মতন পাথর বা বোল্ডার, চোখের নিমেষে পাহাড় থেকে উল্কার মতন ধেয়ে এসে রাস্তার সাইডে দাঁড় করা গাড়ি দুটোর উপরে পড়লো। কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার, গাড়িতে বসা মানুষগুলো গান শুনছিলো, কেবল হয়তো ঘাড় টুকু ঘোরাতে পেরেছিল ওরাও। তারপর? গাড়ি দুটো দুমড়ে মুচড়ে চ্যাপ্টা হয়ে গেল, সেই সাথে গাড়ির মানুষগুলোও! এক লহমায় আবেশ অনাথ হয়ে গেল সেই ক্ষণিকের আতঙ্কময় দুর্ঘটনায়। শোকে পাথর আবেশ ওই স্পটেই জ্ঞ্যাণ হারিয়ে রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল।জ্ঞ্যাণ ফিরতে ও নিজেকে এক সরকারি হাসপাতালের বেডে খুঁজে পেয়েছিল। কারা কিভাবে ওকে নিয়ে এসেছিল, সেসব আরেক ইতিহাস। আবেশ ফিরে এসে বারুইপুরের বসদ ভিটে, সম্পত্তি সবই বেচে দিয়েছিল প্রায় জলের দরেই বলতে গেলে, জীবন তার ছারখার হয়ে গিয়েছিল। ওখানে থাকা ছিল তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল। সেই টাকায় আবেশ বেকবাগানে ছোট্ট দুই কামরার এক ফ্ল্যাট কিনে বাকি টাকা ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিট করে। উত্তরাধিকার সূত্রে যা পেয়েছিল তা জলের দরে বেচেও আবেশের হাতে টাকাকড়ি বিস্তরই এসেছিল। কিন্তু সেসবে কি মানুষের মন ভোলে? এমন ঘটনার পরে কোন মানুষটা শান্তিতে দিন কাটাতে পারে? আবেশ হাজার চেষ্টা করেও নিজেকে সামলাতে পারছিলো না। অনেক মনোবিদ, অনেক চিকিৎসকের কাছে গিয়েও আবেশ নিজেকে উদ্ভ্রান্ত হিসেবেই খুঁজে পাচ্ছিল। এক অদ্ভুত অপরাধবোধ আবেশকে কুরে কুরে খাচ্ছিল, খালি মনে হতো এই চরম দুর্ঘটনার জন্যে সেই দায়ী। এরকম অবস্থায় হঠাৎ এক বন্ধুর পরামর্শে এক প্রকার নিমরাজি হয়েই আবেশ পৌঁছেছিল এক তান্ত্রিকের আড্ডায়। আসলে আবেশ এসব তন্ত্র মন্ত্রকে স্রেফ বুজরুকি আর মানুষ ঠকানোর ফন্দি হিসেবেই ভাবতো। ফলে যখন সে গিয়ে পৌঁছালো অবশেষে সিদ্ধ তান্ত্রিক আচার্য অশোক চাটুজ্যের চেম্বারে, তখন তার চেতনা জুড়ে এক রাশ বিরক্তি।
নিরস বদনে সামনে তাকিয়ে সেদিন সে দেখতে পেয়েছিল তার জীবনে আসা এক অসাধারণ মানুষকে প্রথমবার। খুবই সাধারণ বেশভূষা মানুষটার, জটা জুটো ধারী একটা ইমেজ আবেশের মাথায় ছিল। এ মানুষ তার ধারে কাছেই নেই। স্মিত হেসে প্রৌড়ত্ব পার করে বার্ধক্যের চৌকাঠে পা রাখা সৌম্য দর্শন মানুষটা প্রথমেই বলেছিল এক অদ্ভুত কথা- এসো, বসো। চা আর বিস্কিট দিতে বলেছি, সাথে অল্প তেলেভাজা। খাওয়াদাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছো তুমি। ওগুলো খেয়্র তারপর বাড়ি চলে যাও। আজ ঠিক করে তুমি স্বপ্নটা দ্যখার জন্যে প্রস্তুত নও।
আবেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল - স্বপ্ন? মানে? খামোকা স্বপ্ন দেখতে যাবো কেন? আমি কি এখাবে শুতে এসেছি নাকি? কাউন্সেলিং বোঝেন? সেটা যদি পারেন কিছু তো করুন, অনেক বড় হেল্প হবে। নয়তো মাফ করবেন, ওসব তেলেভাজা আর চায়ে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। আর হ্যাঁ আপনার ফিজটা আমি বরং এখনই দিই, সেটা দরকারী, চেম্বারে ঢোকার মুখেও দেখলাম লেখা আছে, প্রথম ভিজিটে আপনি ২৫০০ টাকা নিয়ে থাকেন। আসুন, আপনার ফিজ।
আবার আকর্ণ হেসে বলেছিলেন অশোকবাবু - টাকা আমি নেবোনা। আজও না, কালও নয়, কখনোই নয়। তবে তোমায় কথা দিতে হবে আজ খেয়েদেয়ে পরশু শুক্লা ত্রয়োদশীতে তুমি আমার চেম্বারে আর একবার আসবে। তারপরের ব্যাপার পরেই দ্যাখা যাবে।
অশোকবাবু সত্যিই কথা রেখেছিলেন আর আবেশও এই পিতৃপ্রতিম মানুষটার আন্তরিক অনুরোধে কোনো খাদ পায়নি। আবেশ এসেছিল পরেরদিন। অশোকবাবু আবেশকে চেম্বারের ইজি চেয়ারে শুইয়ে আবেশকে হয়তো সম্মোহিতই করেছিল। আবেশের গায়ে কাঁটা দেয় আজও সেদিনের কথা ভাবলে। স্বপ্নের ঘোরে আবেশ পৌঁছে গিয়েছিল সেই পাহাড়ি রাস্তাটার কাছে, কেবল চারিদিক ফাঁকা, গাড়িঘোড়া কিচ্ছু নেই, কেবল আবেশের পরিভার ছিল, ওদেরকে আবেশ দেখতে পেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল। তারপর ওরা আবেশকে বলেছিল ও যেন ওদেরকে কখনো না ভোলে আর জীবনকে ওদেরই মুখ চেয়ে নষ্ট না হতে দেয়। আর মা মাথায় হাত রেখে বলেছিল- তোর ভালো হবে, খুঁটি পেয়েছিস একটা, ধরে রাখ শক্ত করে, তাহলে আর ভেসে যাবিনা! চোখ খুলে সামনে অশোকবাবুকে দেখতে পেয়ে ও অশ্যকবাবুকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতন বহুক্ষন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল। আর অশোকবাবু অপার অপত্যস্নেহে আবেশের মাথায়, পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলেছিলেন- কেঁদে নাও খুঁটিটা ধরে, এরপর তোমার অনেক কাজ। আমি তোমায় কেবল পথ দ্যাখাবো, হাঁটতে কিন্তু তোমাকেই হবে, একা একা। তুমি শক্ত হও, তবেই সে সফর সম্ভব।