*** সুগারক্রাস ***
আমি নীল রয়, এখন বয়েস ৬৫, এক সময়ের প্রথিতযশা চর্ম বিশারদ, সারা জীবন নিজের ব্যাবসা নিয়েই মেতে থাকতাম। নিজের তিনতলা বাড়ি, চারটি ফ্ল্যাট। তিনটি ভাড়া দেয়া আর একটিতে আমার ছেলে আর ওর মা থাকে। ছাদে একটি ওয়ান রুম উইথ বাথ ফ্ল্যাট বানিয়ে নিয়েছি আমার নিজের জন্য। আমার বার্ধক্যের বারানসী। সিম্পল একটা খাট, একটা আলমারি আর একটা টেবিলের ওপর ল্যাপটপ সাথে একটা ডেস্কটপ কম্পুটার। অফুরন্ত সময়। নিজের মনে কম্পিউটারে প্রযুক্তির সাহায্যে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াই। কিছুদিন ধরে ইন্টারনেটে চ্যাটরুম গুলোতে ঘুরে বেড়াতে আমার বেশ মজা লাগছে। কত যে চ্যাট রুম, বেশির ভাগই আমেরিকান। একদিন চ্যাট রুম গুলো ঘাটতে ঘাটতে একটা আমার পছন্দ হলো টিন চ্যাট ডট অরগ। ওপেন করে ফেললাম। নিয়মে লেখা আছে ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়েসীদের জন্য। দু ভাবে সেই রুমে এন্ট্রি নেয়া যায়। গেস্ট এন্ট্রি আর রেজিস্টারড এন্ট্রি। রেজিস্টার্ড হলে ছবি দিয়ে নিজের একটা প্রোফাইল বানিয়ে নেয়া যায়। কৌতুহলী মন, ইচ্ছে হলো দেখতে আজকের টিন এজ ছেলে মেয়েরা কি ভাবে, এই প্রযুক্তির যুগে তারা বড় হয়ে উঠছে, আমাদের অতিত টিনএজ মানষিকতার সাথে আজকের ছেলেমেয়ে দের পার্থক্য কতটা হয়েছে এই সব। যাই হোক নিয়ম মেনে একটা প্রোফাইল বানিয়ে ফেললাম। প্রোফাইলে আমার নাম সুমন বোস বয়েস ১৯ থাকি বর্ধমানে মামার বাড়ি, নেট থেকে খুঁজে একটা ওই বয়েসি সুন্দর ছেলের ছবিও সেটে দিলাম । সময় পেলেই বসে পরি ডেস্কটপ খুলে। কম্পুটারে একটা সুবিধা হচ্ছে, একসাথে অনেকগুলো সাইট খুলে কাজ করা যায়। প্রথম দিন টিনচ্যাট খুলে বসেছি। এখন আমি ৬৫ বছরের নীল রয় নই, আমি ১৯ বছরের সুমন বোস কলেজের বিএসসি ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্ট। সাইটের ডান দিকে ইচ্ছে করলে এই মুহুর্তে কতজন আর কে কে কোন কোন দেশের ইউজার রা প্রেজেন্ট দ্যাখা যায়। আর একটা অপশন আছে ইচ্ছে করলে যে কাউকেই প্রাইভেটে নিয়ে কথা বলা যায়।
এই মুহুর্তে ২৬৫ জন ইউজার প্রেজেন্ট। সকলের সাথে সকলের চুটিয়ে কথাবার্তা চলছে, সবই ইংরেজিতে। এটাও মেন্ডেটারি, মেইন এ ইংরেজি ছাড়া টেক্সট করা যাবে না। আমি প্রথম দিন, কাউকে চিনি না, তাই লিখলাম, Good morning all my friends . I am new here লিখে সেন্ড করতেই দেখি আমার টেক্সটা এন্টার হয়ে গেছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ট্যাগ করে টেক্সট আসা শুরু হলো welcome friend , Good morning । কাকে কি বলবো জানি না, কাউকেই তো চিনি না। তাই তখনকার মত লগ আউট হয়ে গেলাম। এই ভাবে দিন কাটে, চ্যাট রুমের মেইনে কিছু কিছু কথাবার্তা হয়, অনেক চ্যাট রুমের সর্ট কাট word শিখে ফেলেছি । hmu ( hit me up) whatsup ( how are u) এই রকম আরো অনেক শব্দ।
একদিন হটাত একটা pm মানে Private message. ইংরেজি হরফে বাংলা লেখা আমার প্রাইভেটে ফুটে উঠলো। হাই আমি সুগারক্রাস। কলকাতায় থাকি। আপনাকে বাঙালী দেখে গল্প করতে এলাম। ফ্রী থাকলে কথা বলুন না। আমি এক সেকেন্ডে ওর বাইও টা দেখে নিলাম। নাম সুগারক্রাস বয়েস ১৮ নিবাস কলকাতা আর প্রোফাইলে একটি ফুটফুটে মেয়ের ছবি । ভালো লাগলো প্রথমেই একটি মিষ্টি মেয়ের ডাক পেয়ে। আমিও রিপ্লাই দিলাম। হা আমি একদম ফ্রী, কারণ এখানে আমি একেবারেই নতুন, তাই আমার কোনো বন্ধু জোটেনি এখনো। ভালো লাগছে এই মুহুর্তে একটি মিষ্টি মেয়ের বন্ধুত্বের ডাক পেয়ে। তবে বড়ো অদ্ভুত লাগছে এত মিষ্টি একটি মেয়ের এই রকম অদ্ভুত নাম দেখে। আমার এই রিপ্লাই পড়ে মেয়ের সেকি খিলখিল করে হাসি। বলছে আপনি কি সেকেলে মানুষ নাকি? সুগারক্রাস গ্রুপের নাম শোনেন নি? আমি সুগারক্রাস গ্রুপের খুব ফ্যান তাই এখানে নাম নিয়েছি সুগারক্রাস। পরে অবশ্য আমি গুগুল খুঁজে দেখেছি, এই শতাব্দীর খুব নামকরা আমেরিকান গানের ব্যান্ডের নাম সুগারক্রাস। আমার ওর সাথে কথা বলার আগ্রহ দেখে বললো আপনাকে আমার ওই বিদঘুটে নামে ডাকতে হবে না, আমাকে আপনি জিনিয়া বলে ডাকবেন। আমার নাম জিনিয়া ঘোষ। যাদবপুরে থাকি, ইংলিস মিডিয়াম স্কুলে ১২ ক্লাসে পড়ি। খুবই সপ্রতিভ একটি মেয়ে, কথার সাথে ইংরেজি শব্দের বহুল ব্যাবহার বলেই দিচ্ছে ইংরেজিতে খুবই সরগর। তার পর খানিক্ষন আমার হাল হকিকত কোথায় থাকি কি পড়ি হবি কি, এই সব জেনে নেয়া। আমিও অবশ্য খুব অনায়াসে আমার ফেক বাইও ওকে বলে গেলাম। তখনকার মত ইন্ট্রোডাকশনের পালা শেষ।
এই ভাবে দুটো অসম বয়েসী মানুষের বন্ধুত্বের শুরু। কিন্তু জিনিয়ার কাছে আমিতো সুমন বোস, বয়েস ১৯। রোজই সাইট খুলে আগে দেখি ইউজার লিস্টে ওর নাম আছে কিনা। অবশ্য জিনিয়া বলেই দিয়েছে শনিবার রবিবার ছাড়া ওর স্কুল আওয়ার সকাল এগারোটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। আর স্কুলে মোবাইল নিষিদ্ধ। তাই দুপুরে যেনো ওকে না খুঁজি।
আমি অবাক হয়ে ভাবি, নিজেকে বিশ্লেষণ করি, জিনিয়া আমার নাতনীর বয়েসী একটি মেয়ে, কেনো ধীরে ধীরে ওর জন্য একটা টান অনুভব করছি। আমি ইউরোপীয়ান এক নাম করা মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডের একটা বাংলা ভার্শন বই পড়েছিলাম। তাতে মানুষের মনের গভীরে অজানা অনেক আশা আকাঙ্খা গুলো লুকিয়ে থাকে, সে গুলো কখনো কখনো তার অজান্তেই মনের মঝে ভেসে ওঠে, সেখানে বয়েসের কোনো বাধা থাকে না। সেই ভাবেই হয়তো জিনিয়ার প্রতি আমার টান, সব সময় ওকে দেখার অদম্য ইচ্ছা, হোক না সেটা কাল্পনিক আমাকে প্রতিনিয়ত হন্ট করতে শুরু করেছে। সারাদিনে বিকেল থেকে কতবার যে সাইট৷ খুলে দেখি জিনিয়া অন লাইন কিনা। যেই দেখতে পাই ও অনলাইন, মনটা কেমন খুশিতে ঝলমল করে ওঠে। তার পর শুরু হয় আমাদের কথা, ও অনবরত অনর্গল কথা বলতে থাকে, আর আমি শ্রোতা। কিছু দিনের মধ্যেই ওর পরিবারের সব কিছু আমি জেনে গেছি। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে সন্তান। বাবার একটা ইঞ্জিনিয়ারিং পার্টস এর ব্যাবসা আছে, মা হাউসওয়াইফ। মেয়েকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াচ্ছেন। পড়াশোনায় জিনিয়া খুবই মেরিটোরিয়াস। বন্ধু বান্ধব নেই বললেই চলে। হবি সময় পেলেই চ্যাট রুম সার্ফ করা। এইভাবে ওর সাথে গল্প করে আড্ডা মেরে দিন কাটে। আমাদের সব কথাবার্তাই কিন্তু টেক্সটে। সেই কাল্পনিক লেখাগুলোই কেমন যেনো জিবন্ত হয়ে ওঠে আমাদের দুজনের কাছে।
ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারছি জিনিয়া আমার প্রতি, সরি ভুল বললাম সুমনের প্রতি একটু একটু দুর্বল হয়ে পরছে। আমি অভিজ্ঞ মানুষ ওর কথাবার্তা তে বুঝতে পারছি। কিন্তু খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে, কোনো রকম সেক্সটিং একেবারেই বরদাস্ত করতে পারে না। কখনো যদি আমি একটু মজা করার জন্য কিছু বলেছি, সঙ্গে সঙ্গে আমাকে এক ধমক। এই ভাবেই দিন কেটে যায়। বছর গড়িয়ে চলে, ওর CBSC exam দোরগোড়ায়। আমার ওপরে কড়া নির্দেশ, ও যতক্ষণ আমার সাথে কথা বলবে, সেদিনের জন্য ততটাই আমার আয়ু। দেখতে দেখতে এক্সাম এসে গেলো, একদিন শেষও হলো।
জিনিয়ার রেজাল্ট না বের হওয়া পর্যন্ত অফুরন্ত ছুটি। চ্যাট সাইটে দুজন কাল্পনিক চরিত্র গল্প গুজবে মেতে থাকে। হটাৎ একদিন জিনিয়ার একটা মেসেজ আমার প্রোফাইলে। জিনিয়া অফ লাইন। আমিতো অবাক। সকালেই ওর সাথে আমার কথা হয়েছে। কৌতুহল নিয়ে পড়া শুরু করলাম ওর মেসেজ টা।
জিনিয়ার কথাতেই এখানে বলছি।
সুমন, তোমাকে আমি আজ আমার জীবনের একটা সত্যি কথা বলবো বলে এই মেসেজ টা লিখেছি। যে কথা নিজের মুখে তোমাকে বলতে পারিনি।
সুমন তুমি খুব মিষ্টি আমার এক বন্ধু, হয়তো তুমি প্রযুক্তির সৃষ্ট। এতদিনে কোনো দিন তোমাকে দেখিনি, তোমার গলার আওয়াজ শুনিনি। তুমিও আমাকে দেখনি। জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো,আমিও তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমাদের দুজনের ভালোবাসার মধ্যে কোনো রকম শারীরিক চাহিদার কোনো স্থান নেই । তোমাকে বলতে পারিনি বেশ কিছুদিন হোলো আমার একজন ছেলে বন্ধু আমার জীবনে এসেছে। ওর সাথে মেলামেশা করে, জীবনের আরেকটা দিক আমার কাছে খুলে গেছে। বুঝেছি শারীরিক ধরা ছোঁয়া না হলে সত্যিকারের ভালোবাসা জন্মায় না। তাই আমরা দুজনে মাঝে মাঝে ওর পরিচিত এক হোটেলে এক সাথে এক ঘরে এক বিছানায় সময় কাটাতে যাই। কিন্তু সেই সময় জানি না কেন জানি তোমার কথা আমার মনে হতে থাকে। সুমন আজ তোমাকে আমার দিক থেকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি এসো কাল্পনিক খোলস টা খুলে তোমার ভালোবাসার জিনিয়ার কাছে। চলো না আমার সাথে ওই হোটেলে, খুব মজা করে গল্প করবো। আসবে? হা আর একটা কথা, আমি আর আমার ছেলে বন্ধু দুদিনের জন্য দীঘা যাচ্ছি। যাবে আমাদের সাথে? চলোনা জীবনটা কে এঞ্জয় করি?
জিনিয়ার এই মেসেজ টা পড়ে আমার কয়েক মিনিট লেগেছিল ধাতস্থ হতে।
আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলো আমাদের টিনএজ আর আজকের টিনএজ ছেলেমেয়েদের মানসিকতার পরিবর্তন। যাই হোক আমি জিনিয়ার মেসেজের একটা রিপ্লাই দিয়েছিলাম।
লিখেছিলাম,
জিনিয়া, তোমার মেসেজ টা পড়লাম। ভালোই লাগলো তোমার জীবনে সুন্দর একটি ছেলে বন্ধুর আবির্ভাবে। তোমার আজ যা বয়েস তাতে জীবন টাকে পরিপূর্ণ ভাবে এঞ্জয় করার সময়। আমাকে তোমার এই আজকের পরিবর্তিত জীবনে মিষ্টি সময় কাটানোর আবাহনের জন্য ধন্যবাদ। জিনিয়া, আমি আজকের দিনের ছেলে হলেও আমার কাছে রিয়াল আর ভার্চুয়াল জগত দুটো একেবারেই আলাদা। কল্পনা আমার কাছে কল্পনা আর বাস্তব সেটাকে নিয়েই তো আমি সুমন বোস। তুমি আমার কাছে ইন্টারনেটের এক কাল্পনিক মিষ্টি একটি বান্ধবী। তোমাকে আমি আমার কল্পনার মধ্যেই রাখতে চাই। তাই তোমাকে অনেক শুভেচ্ছা তুমি তোমার রিয়াল ছেলে বন্ধুর সাথে মজা করে এঞ্জয় করে সময় কাটাও।
তার পর থেকে দেখেছি জিনিয়ার টিন চ্যাটের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। ওর সাথে যোগাযোগ টা হটাৎ করে বন্ধ হয়ে যাওয়াতে এই বয়স্ক মানুষটার মনটাও কিছুদিন খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
আজ মাঝে মাঝে ওর কথা মনে পরে। কি জানি কেমন আছে, কোন কলেজে পড়ছে। জানতাম না সুগারক্রাস মানে কি। আজ জানি সুগারক্রাস মানে আমার হারিয়ে যাওয়া মিষ্টি একটি বান্ধবীর নাম।
আমি নীল রয়, এখন বয়েস ৬৫, এক সময়ের প্রথিতযশা চর্ম বিশারদ, সারা জীবন নিজের ব্যাবসা নিয়েই মেতে থাকতাম। নিজের তিনতলা বাড়ি, চারটি ফ্ল্যাট। তিনটি ভাড়া দেয়া আর একটিতে আমার ছেলে আর ওর মা থাকে। ছাদে একটি ওয়ান রুম উইথ বাথ ফ্ল্যাট বানিয়ে নিয়েছি আমার নিজের জন্য। আমার বার্ধক্যের বারানসী। সিম্পল একটা খাট, একটা আলমারি আর একটা টেবিলের ওপর ল্যাপটপ সাথে একটা ডেস্কটপ কম্পুটার। অফুরন্ত সময়। নিজের মনে কম্পিউটারে প্রযুক্তির সাহায্যে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াই। কিছুদিন ধরে ইন্টারনেটে চ্যাটরুম গুলোতে ঘুরে বেড়াতে আমার বেশ মজা লাগছে। কত যে চ্যাট রুম, বেশির ভাগই আমেরিকান। একদিন চ্যাট রুম গুলো ঘাটতে ঘাটতে একটা আমার পছন্দ হলো টিন চ্যাট ডট অরগ। ওপেন করে ফেললাম। নিয়মে লেখা আছে ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়েসীদের জন্য। দু ভাবে সেই রুমে এন্ট্রি নেয়া যায়। গেস্ট এন্ট্রি আর রেজিস্টারড এন্ট্রি। রেজিস্টার্ড হলে ছবি দিয়ে নিজের একটা প্রোফাইল বানিয়ে নেয়া যায়। কৌতুহলী মন, ইচ্ছে হলো দেখতে আজকের টিন এজ ছেলে মেয়েরা কি ভাবে, এই প্রযুক্তির যুগে তারা বড় হয়ে উঠছে, আমাদের অতিত টিনএজ মানষিকতার সাথে আজকের ছেলেমেয়ে দের পার্থক্য কতটা হয়েছে এই সব। যাই হোক নিয়ম মেনে একটা প্রোফাইল বানিয়ে ফেললাম। প্রোফাইলে আমার নাম সুমন বোস বয়েস ১৯ থাকি বর্ধমানে মামার বাড়ি, নেট থেকে খুঁজে একটা ওই বয়েসি সুন্দর ছেলের ছবিও সেটে দিলাম । সময় পেলেই বসে পরি ডেস্কটপ খুলে। কম্পুটারে একটা সুবিধা হচ্ছে, একসাথে অনেকগুলো সাইট খুলে কাজ করা যায়। প্রথম দিন টিনচ্যাট খুলে বসেছি। এখন আমি ৬৫ বছরের নীল রয় নই, আমি ১৯ বছরের সুমন বোস কলেজের বিএসসি ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্ট। সাইটের ডান দিকে ইচ্ছে করলে এই মুহুর্তে কতজন আর কে কে কোন কোন দেশের ইউজার রা প্রেজেন্ট দ্যাখা যায়। আর একটা অপশন আছে ইচ্ছে করলে যে কাউকেই প্রাইভেটে নিয়ে কথা বলা যায়।
এই মুহুর্তে ২৬৫ জন ইউজার প্রেজেন্ট। সকলের সাথে সকলের চুটিয়ে কথাবার্তা চলছে, সবই ইংরেজিতে। এটাও মেন্ডেটারি, মেইন এ ইংরেজি ছাড়া টেক্সট করা যাবে না। আমি প্রথম দিন, কাউকে চিনি না, তাই লিখলাম, Good morning all my friends . I am new here লিখে সেন্ড করতেই দেখি আমার টেক্সটা এন্টার হয়ে গেছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ট্যাগ করে টেক্সট আসা শুরু হলো welcome friend , Good morning । কাকে কি বলবো জানি না, কাউকেই তো চিনি না। তাই তখনকার মত লগ আউট হয়ে গেলাম। এই ভাবে দিন কাটে, চ্যাট রুমের মেইনে কিছু কিছু কথাবার্তা হয়, অনেক চ্যাট রুমের সর্ট কাট word শিখে ফেলেছি । hmu ( hit me up) whatsup ( how are u) এই রকম আরো অনেক শব্দ।
একদিন হটাত একটা pm মানে Private message. ইংরেজি হরফে বাংলা লেখা আমার প্রাইভেটে ফুটে উঠলো। হাই আমি সুগারক্রাস। কলকাতায় থাকি। আপনাকে বাঙালী দেখে গল্প করতে এলাম। ফ্রী থাকলে কথা বলুন না। আমি এক সেকেন্ডে ওর বাইও টা দেখে নিলাম। নাম সুগারক্রাস বয়েস ১৮ নিবাস কলকাতা আর প্রোফাইলে একটি ফুটফুটে মেয়ের ছবি । ভালো লাগলো প্রথমেই একটি মিষ্টি মেয়ের ডাক পেয়ে। আমিও রিপ্লাই দিলাম। হা আমি একদম ফ্রী, কারণ এখানে আমি একেবারেই নতুন, তাই আমার কোনো বন্ধু জোটেনি এখনো। ভালো লাগছে এই মুহুর্তে একটি মিষ্টি মেয়ের বন্ধুত্বের ডাক পেয়ে। তবে বড়ো অদ্ভুত লাগছে এত মিষ্টি একটি মেয়ের এই রকম অদ্ভুত নাম দেখে। আমার এই রিপ্লাই পড়ে মেয়ের সেকি খিলখিল করে হাসি। বলছে আপনি কি সেকেলে মানুষ নাকি? সুগারক্রাস গ্রুপের নাম শোনেন নি? আমি সুগারক্রাস গ্রুপের খুব ফ্যান তাই এখানে নাম নিয়েছি সুগারক্রাস। পরে অবশ্য আমি গুগুল খুঁজে দেখেছি, এই শতাব্দীর খুব নামকরা আমেরিকান গানের ব্যান্ডের নাম সুগারক্রাস। আমার ওর সাথে কথা বলার আগ্রহ দেখে বললো আপনাকে আমার ওই বিদঘুটে নামে ডাকতে হবে না, আমাকে আপনি জিনিয়া বলে ডাকবেন। আমার নাম জিনিয়া ঘোষ। যাদবপুরে থাকি, ইংলিস মিডিয়াম স্কুলে ১২ ক্লাসে পড়ি। খুবই সপ্রতিভ একটি মেয়ে, কথার সাথে ইংরেজি শব্দের বহুল ব্যাবহার বলেই দিচ্ছে ইংরেজিতে খুবই সরগর। তার পর খানিক্ষন আমার হাল হকিকত কোথায় থাকি কি পড়ি হবি কি, এই সব জেনে নেয়া। আমিও অবশ্য খুব অনায়াসে আমার ফেক বাইও ওকে বলে গেলাম। তখনকার মত ইন্ট্রোডাকশনের পালা শেষ।
এই ভাবে দুটো অসম বয়েসী মানুষের বন্ধুত্বের শুরু। কিন্তু জিনিয়ার কাছে আমিতো সুমন বোস, বয়েস ১৯। রোজই সাইট খুলে আগে দেখি ইউজার লিস্টে ওর নাম আছে কিনা। অবশ্য জিনিয়া বলেই দিয়েছে শনিবার রবিবার ছাড়া ওর স্কুল আওয়ার সকাল এগারোটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। আর স্কুলে মোবাইল নিষিদ্ধ। তাই দুপুরে যেনো ওকে না খুঁজি।
আমি অবাক হয়ে ভাবি, নিজেকে বিশ্লেষণ করি, জিনিয়া আমার নাতনীর বয়েসী একটি মেয়ে, কেনো ধীরে ধীরে ওর জন্য একটা টান অনুভব করছি। আমি ইউরোপীয়ান এক নাম করা মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডের একটা বাংলা ভার্শন বই পড়েছিলাম। তাতে মানুষের মনের গভীরে অজানা অনেক আশা আকাঙ্খা গুলো লুকিয়ে থাকে, সে গুলো কখনো কখনো তার অজান্তেই মনের মঝে ভেসে ওঠে, সেখানে বয়েসের কোনো বাধা থাকে না। সেই ভাবেই হয়তো জিনিয়ার প্রতি আমার টান, সব সময় ওকে দেখার অদম্য ইচ্ছা, হোক না সেটা কাল্পনিক আমাকে প্রতিনিয়ত হন্ট করতে শুরু করেছে। সারাদিনে বিকেল থেকে কতবার যে সাইট৷ খুলে দেখি জিনিয়া অন লাইন কিনা। যেই দেখতে পাই ও অনলাইন, মনটা কেমন খুশিতে ঝলমল করে ওঠে। তার পর শুরু হয় আমাদের কথা, ও অনবরত অনর্গল কথা বলতে থাকে, আর আমি শ্রোতা। কিছু দিনের মধ্যেই ওর পরিবারের সব কিছু আমি জেনে গেছি। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে সন্তান। বাবার একটা ইঞ্জিনিয়ারিং পার্টস এর ব্যাবসা আছে, মা হাউসওয়াইফ। মেয়েকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াচ্ছেন। পড়াশোনায় জিনিয়া খুবই মেরিটোরিয়াস। বন্ধু বান্ধব নেই বললেই চলে। হবি সময় পেলেই চ্যাট রুম সার্ফ করা। এইভাবে ওর সাথে গল্প করে আড্ডা মেরে দিন কাটে। আমাদের সব কথাবার্তাই কিন্তু টেক্সটে। সেই কাল্পনিক লেখাগুলোই কেমন যেনো জিবন্ত হয়ে ওঠে আমাদের দুজনের কাছে।
ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারছি জিনিয়া আমার প্রতি, সরি ভুল বললাম সুমনের প্রতি একটু একটু দুর্বল হয়ে পরছে। আমি অভিজ্ঞ মানুষ ওর কথাবার্তা তে বুঝতে পারছি। কিন্তু খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে, কোনো রকম সেক্সটিং একেবারেই বরদাস্ত করতে পারে না। কখনো যদি আমি একটু মজা করার জন্য কিছু বলেছি, সঙ্গে সঙ্গে আমাকে এক ধমক। এই ভাবেই দিন কেটে যায়। বছর গড়িয়ে চলে, ওর CBSC exam দোরগোড়ায়। আমার ওপরে কড়া নির্দেশ, ও যতক্ষণ আমার সাথে কথা বলবে, সেদিনের জন্য ততটাই আমার আয়ু। দেখতে দেখতে এক্সাম এসে গেলো, একদিন শেষও হলো।
জিনিয়ার রেজাল্ট না বের হওয়া পর্যন্ত অফুরন্ত ছুটি। চ্যাট সাইটে দুজন কাল্পনিক চরিত্র গল্প গুজবে মেতে থাকে। হটাৎ একদিন জিনিয়ার একটা মেসেজ আমার প্রোফাইলে। জিনিয়া অফ লাইন। আমিতো অবাক। সকালেই ওর সাথে আমার কথা হয়েছে। কৌতুহল নিয়ে পড়া শুরু করলাম ওর মেসেজ টা।
জিনিয়ার কথাতেই এখানে বলছি।
সুমন, তোমাকে আমি আজ আমার জীবনের একটা সত্যি কথা বলবো বলে এই মেসেজ টা লিখেছি। যে কথা নিজের মুখে তোমাকে বলতে পারিনি।
সুমন তুমি খুব মিষ্টি আমার এক বন্ধু, হয়তো তুমি প্রযুক্তির সৃষ্ট। এতদিনে কোনো দিন তোমাকে দেখিনি, তোমার গলার আওয়াজ শুনিনি। তুমিও আমাকে দেখনি। জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো,আমিও তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমাদের দুজনের ভালোবাসার মধ্যে কোনো রকম শারীরিক চাহিদার কোনো স্থান নেই । তোমাকে বলতে পারিনি বেশ কিছুদিন হোলো আমার একজন ছেলে বন্ধু আমার জীবনে এসেছে। ওর সাথে মেলামেশা করে, জীবনের আরেকটা দিক আমার কাছে খুলে গেছে। বুঝেছি শারীরিক ধরা ছোঁয়া না হলে সত্যিকারের ভালোবাসা জন্মায় না। তাই আমরা দুজনে মাঝে মাঝে ওর পরিচিত এক হোটেলে এক সাথে এক ঘরে এক বিছানায় সময় কাটাতে যাই। কিন্তু সেই সময় জানি না কেন জানি তোমার কথা আমার মনে হতে থাকে। সুমন আজ তোমাকে আমার দিক থেকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি এসো কাল্পনিক খোলস টা খুলে তোমার ভালোবাসার জিনিয়ার কাছে। চলো না আমার সাথে ওই হোটেলে, খুব মজা করে গল্প করবো। আসবে? হা আর একটা কথা, আমি আর আমার ছেলে বন্ধু দুদিনের জন্য দীঘা যাচ্ছি। যাবে আমাদের সাথে? চলোনা জীবনটা কে এঞ্জয় করি?
জিনিয়ার এই মেসেজ টা পড়ে আমার কয়েক মিনিট লেগেছিল ধাতস্থ হতে।
আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলো আমাদের টিনএজ আর আজকের টিনএজ ছেলেমেয়েদের মানসিকতার পরিবর্তন। যাই হোক আমি জিনিয়ার মেসেজের একটা রিপ্লাই দিয়েছিলাম।
লিখেছিলাম,
জিনিয়া, তোমার মেসেজ টা পড়লাম। ভালোই লাগলো তোমার জীবনে সুন্দর একটি ছেলে বন্ধুর আবির্ভাবে। তোমার আজ যা বয়েস তাতে জীবন টাকে পরিপূর্ণ ভাবে এঞ্জয় করার সময়। আমাকে তোমার এই আজকের পরিবর্তিত জীবনে মিষ্টি সময় কাটানোর আবাহনের জন্য ধন্যবাদ। জিনিয়া, আমি আজকের দিনের ছেলে হলেও আমার কাছে রিয়াল আর ভার্চুয়াল জগত দুটো একেবারেই আলাদা। কল্পনা আমার কাছে কল্পনা আর বাস্তব সেটাকে নিয়েই তো আমি সুমন বোস। তুমি আমার কাছে ইন্টারনেটের এক কাল্পনিক মিষ্টি একটি বান্ধবী। তোমাকে আমি আমার কল্পনার মধ্যেই রাখতে চাই। তাই তোমাকে অনেক শুভেচ্ছা তুমি তোমার রিয়াল ছেলে বন্ধুর সাথে মজা করে এঞ্জয় করে সময় কাটাও।
তার পর থেকে দেখেছি জিনিয়ার টিন চ্যাটের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। ওর সাথে যোগাযোগ টা হটাৎ করে বন্ধ হয়ে যাওয়াতে এই বয়স্ক মানুষটার মনটাও কিছুদিন খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
আজ মাঝে মাঝে ওর কথা মনে পরে। কি জানি কেমন আছে, কোন কলেজে পড়ছে। জানতাম না সুগারক্রাস মানে কি। আজ জানি সুগারক্রাস মানে আমার হারিয়ে যাওয়া মিষ্টি একটি বান্ধবীর নাম।