Nilabha
Wellknown Ace
ঘাসফড়িং
"ভালোবাসা কী?" এই প্রশ্নের সবথেকে সহজ উত্তর জানতে চাইলে আপনাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষের উত্তর কিছুটা এইরকম হবে যে, "একটা ছেলের আর একটা মেয়ের মধ্যে গড়ে ওঠা শারীরিক ও মানসিক প্রেমই হলো ভালোবাসা।" আবার কিছু মানুষের উত্তর এরম ও হয় যে "দুটো মানুষের একে অপরের প্রতি এক বিশেষ নিঃস্বার্থ অনুভূতি হলো ভালোবাসা।" দুটো সংজ্ঞা আপাতভাবে বেশ একই রকম লাগলেও বাস্তবিক ভিত্তিতে দুটির রকম সম্পূর্ণ ভিন্ন। কি ভাবছেন আজ আপনাদের জন্য ভালোবাসার ক্লাসরুম খুলে বসেছি কি না? হেহে না না সেরকম কোনো মনোবাসনা আমার অন্তত নেই। আর ভালোবাসা যেহেতু এক একজনের কাছে এক এক রকমের তাই আমার ধারণা তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার কোনো মানেই হয়না। তাহলে এখন প্রশ্ন হলো এরম উল্টো পাল্টা বকছি কেনো আজ ? আসলে আমি আজ ভালোবাসার একটা সংজ্ঞা খোঁজার চেষ্টা করছি। কিন্তু এখনও অবধি যতগুলো পেলাম তাদের একটাও আমার মনঃপুত হলো না সবকটাতেই কিছু একটা মিসিং বলে মনে হচ্ছে। এবার কি করা যায় বলুন তো? হ্যাঁ একটা ভালো বুদ্ধি এসেছে মাথায়। যেকোনো সংজ্ঞা বোঝার সহজ উপায় কি বলুন তো? তার উদাহরণগুলোকে সঠিকভাবে বোঝা। চলুন আজ একটা গল্পকে আমরা উদাহরণ বানিয়ে ভালোবাসার সংজ্ঞাটা বোঝার চেষ্টা করি। তবে এ গল্প কিন্তু অন্যান্য প্রেম ভালোবাসার গল্পের মতন নয়। এই গল্পের প্রধান চরিত্র হবেন আপনি, আর দ্বিতীয় চরিত্র হবে আপনার ভালোবাসার মানুষটি, আর যদি বাস্তবে আপনার কোনো ভালোবাসার মানুষ নাই থেকে থাকে তো দ্বিতীয় চরিত্রটিকেই নিজের ভালোবাসার মানুষ করে তুলুন না সমস্যা কি? আচ্ছা সব ই তো হলো কিন্তু প্রধান চরিত্রকে অন্যান্য চরিত্রদের থেকে আলাদা করে আমরা চিনব কীকরে? এতো মহা মুশকিলে পড়া গেলো দেখছি, আচ্ছা আমরা না হয় তার নাম দি ঘাসফড়িং।
ঘাসফড়িং কে দেখতে এই ধরুন খানিকটা আপনারই মতন। আপনি আয়নার সামনে দাঁড়ালে যেমন চেহারা ফুটে উঠবে আয়নায় ঠিক তেমন। আর দ্বিতীয় চরিত্রের নাম দেওয়া যাক প্রজাপতি। প্রজাপতি এর চেহারা ধরুন ওই আপনার ভালোবাসার মানুষটির মতন। আর তেমন কেউ আপনার জীবনে না থাকলে আপনি কল্পনা করে নিন এমন কাউকে যাকে আপনি বাস্তবে কখনো নিজের করে পাবেন না কিন্তু তাকে নিজের করে পাবার ইচ্ছে আপনার মধ্যে প্রবল। দেখি চেষ্টা করে গল্পে কিছু মুহূর্তের জন্যেও যদি সেই মানুষটাকে আপনার করে পাইয়ে দিতে পারি।
রাত দশটা অবধি বসে কলেজের প্রজেক্টটা জাস্ট কমপ্লিট করে যখন ফোনটা নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ টা খুললো ঘাসফড়িং ততক্ষণে প্রজাপতির "ওই" "কীরে" "কী করছিস" এই তিনটে মেসেজ ঢুকে গেছে। ইয়ারফোনটা কানে গুঁজে ঘাসফড়িং রিপ্লাই করলো,
- " এই বসে আছি আর গান শুনবো ভাবছি। তুই?"
-" আমি বসে আছি, বাই দা ওয়ে কি গান শুনবি ভাবছিস?"
- " ভাবনা অন দ্য ওয়ে।"
- " তাহলে একটা গান বলছি, ওটা শোন। আমিও শুনবো তাহলে।"
- " কি গান?"
- "দাঁড়া লিংক পাঠাচ্ছি।"
কিছুক্ষণ পরেই টুং করে একটা মেসেজ এলো। স্ক্রীনের ওপর ভেসে উঠলো একটা লিংক আর তার ওপরে একটা থাম্বনেল লাগানো। তার ওপরে লেখা ডিসেম্বরের শহরে। ঘাসফড়িং গানটা চালিয়ে টাইপ করতে শুরু করলো।
-" এটা আবার কি গান? শুনিনি তো আগে।"
- " আরে শোনই না, গানটা হেব্বি লাগে আমার।"
এতক্ষণ গানের মিউজিক চলছিল এবার লিরিকস শুরু হতেই মন দিয়ে শুনতে লাগলো ঘাসফড়িং।
ডিসেম্বর এর শহরে
চেনা শুভেচ্ছা চেনা সেলফোন,
ডিসেম্বর এর শহরে
সবই নিয়নের বিজ্ঞাপন,
ডিসেম্বর এর শহরে
চেনা বন্ধু চেনা নিকোটিন,
ডিসেম্বরের শহরে
ভালোবাসা যেন পোর্সেলিন….
-" কীরে কেমন গানটা?"
এতক্ষণ চোখ বুজে মন দিয়ে গানটা শুনছিল ঘাসফড়িং, মেসেজের আওয়াজ শুনে ফোনটা হাতে নিল। টুকটুক শব্দ করে আঙ্গুল চলতে লাগলো কীবোর্ডের ওপর।
-" বেশ ভালো, লিরিকস গুলো খুব সুন্দর, তবে রিদিমটা একটু বেটার হলে আরো ভালো লাগতো।"
-" হ্যাঁ প্রথম দিকে গানটা খুব স্লো ঠিকই কিন্তু শেষের দিকটা দুর্দান্ত। খেয়াল রাখবি, 'জানি আলোয় ভিজবে চেনা পার্ক স্ট্রিট' এই লাইনটার থেকে।"
-" আচ্ছা।"
- " আজ বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে কি বল?"
- " ধুর কই ঠান্ডা, অন্যান্য বছর ডিসেম্বরের মধ্যেই এমন শীত পড়ে যায় যে কম্বল থেকে বেরোনো যায়না, এখনও ঠিকমত কম্বল চাপা দেবার মত ঠান্ডাই পড়লো না।"
-" হ্যাঁ সেটা অবশ্য ঠিক।"
কিছুক্ষণ দু দিক থেকেই কোনো মেসেজ আসেনা। এত বকবক করলে যা হয় আর কি, কথার স্টক ফুরিয়ে গেছে, এখন দুতরফে ভাবনা চলছে যে কি বলা যায়।
কিছুক্ষণ পরেই প্রজাপতির দিক থেকেই এলো মেসেজ,
-" এখানটা ভালো করে শোন।"
ঘাসফড়িং আবার গানের দিকে মন দিল,
জানি আলোয় ভিজবে চেনা পার্কস্ট্রিট
তবু ট্যাক্সি ধরবে তুমি এয়ারপোর্ট,
নিয়ে সুটকেস ভর্তি শুণ্যতা
হাতছানি দেয় অন্য শহর..
ঘরে ফেরা তোমার অভ্যাসে নেই,
আর পিছু ডাকা আমার সিলেবাসে নেই;
ফিরে পাওয়া এই শহরের ইতিহাসে নেই,
বিষাদ চিহ্ন সানগ্লাসে নেই..
ডিসেম্বরের শহর থেকে যায় অপেক্ষায়
প্রাক্তন ভালোবাসা নিয়ে, প্রাক্তন কলকাতায়,
ডিসেম্বরের শহর থেকে যায় অপেক্ষায়
প্রাক্তন ভালোবাসা নিয়ে, প্রাক্তন কলকাতায়,
সব শীতের শেষে হয়তো বসন্ত আসেনা,
সম্পর্কের ধ্বংসস্তূপ তোমার আমার,
কলকাতায় ..
-" সিরিয়াসলি দারুন গানটা। কিন্তু তুই কীকরে জানলি যে আমার এই জায়গাটাই চলছে?"
-" আরে আমিও তো শুনছিলাম আর তুই যখন শুনতে শুরু করলি আমিও তখনি চালিয়েছিলাম তাই প্রায় একসাথেই চলছিল দুজনের।"
-" ও আচ্ছা এই ব্যাপার।"
-" হুম, এই ব্যাপার।"
আবার কয়েকমিনিট কোনো মেসেজ নেই, ঘাসফড়িং কিছু একটা লিখতে যাবে তখনি প্রজাপতি টাইপ করছে দেখে থেমে গেলো,
-" আচ্ছা একটা জিনিস আমি অনেকদিন ধরে ভাবছিলাম। একবার ট্রাই করবি?"
ঘাসফড়িং একটু সন্দিহান হয়ে টাইপ করে,
-" কী?"
-" টেলিপ্যাথি জানিস তো?"
-" হ্যাঁ, অন্য মানুষের মনের কথা জেনে নেওয়ার কৌশল।"
-" হ্যাঁ তো অনেকটা এরকমই ব্যাপার একবার আমি শুনেছিলাম কোন একটা ইউটিউব ভিডিওতে যে দুটো আলাদা মানুষ যদি একই সময়ে একই ভাবে একই অবস্থায় খুব মন দিয়ে একে অপরের সাথে একই রকমের একটা মুহূর্তের কথা ভাবে তাহলে নাকি দুজনের ভাবনার স্রোত একে অপরের সাথে মিশে যায় আর দুজনেই একই ঘটনা কল্পনা করতে থাকে।"
-" ওহ আচ্ছা, তো তুই কি বলতে চাইছিস?"
-" আমি বলতে চাইছি যে আমরাও এরম করে দেখবো একবার যে সত্যিই এরম কিছু হয় কি না।"
-" ধুর, এসব কিছু হয়না, কিসব বোকা বোকা ব্যাপার।"
-" এই প্লিজ চল না একবার ট্রাই করি, আর তুই ট্রাই না করে কীকরে বলছিস এসব হয়না। হতেই তো পারে, আর বোকা বোকা তো কি তুই আর আমি ছাড়া এসব আর কে জানতে যাচ্ছে?"
-" তা কেউ জানতে যাচ্ছে না ঠিকই।"
-" হ্যাঁ তো ব্যাস তাহলে আজই করবো হ্যাঁ, তুই তো সাড়ে এগারোটা নাগাদ ঘুমোতে যাবি?"
-" হ্যাঁ তবে আরো একটু লেট হয় ওই পৌনে বারোটা বেজেই যায় প্রায় "
-" আচ্ছা তাহলে আমিও আজ একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়বো। আচ্ছা এবার আসল কথা হলো কি নিয়ে ভাবা যায়?"
-" ভাব, ভেবে বল।"
-" সব কি আমি বলবো নাকি তুইও ভাব।"
-" আচ্ছা তাহলে এক কাজ কর, কাল তো পঁচিশে ডিসেম্বর, আমরা কাল সারাদিন একসাথে ঘুরবো কলকাতার কয়েকটা বিশেষ জায়গায়। আর সন্ধ্যেবেলা একদম লাস্টে যাবো পার্ক স্ট্রিট। কেমন এটা?"
-" বেস্ট! আচ্ছা সাড়ে দশটা তো বাজলো তুই বরং খেয়ে আয় আমি বাকি আরো ছোটখাটো কিছু জিনিস ভাবি একটু। "
-" আচ্ছা ভাবো, আমি খেয়ে আসি।"
আধ ঘন্টা বাদে খেয়ে এসে ঘাসফড়িং দেখলো অনেকগুলো মেসেজ এসেছে প্রজাপতির চ্যাটএ। সে পড়তে শুরু করলো।
-" আচ্ছা তাহলে কোথায় কোথায় যাবো একবার ভেবে নি হ্যাঁ কারণ একই জায়গার কথা ভাবতে হবে তো। তাহলে বরং সকাল 10 টা নাগাদ আমরা প্রথমে যাবো রবীন্দ্র সরোবর। সকাল সকাল লেকের পাশটায় ঘুরতে আমার দারুন লাগে। তুই আর আমি হাঁটবো লেকের পাড় দিয়ে হাত ধরে। সেখানে কিছুক্ষণ থাকার পর যাবো ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে। ওখানে কাছাকাছি কোনো একটা বেঞ্চে বসবো আমরা পাশাপাশি তুই আমার কাঁধে বা আমি তোর কাঁধে মাথা রেখে। অনেক গল্প করবো। তারপর দুপুরে কাছাকাছি কোনো রেস্ট্রুরেন্টে যাবো লাঞ্চ করতে। লাঞ্চ করে একটু গড়ের মাঠে গিয়ে বসবো, তুই বসবি আর আমি তোর কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকবো, বা উল্টোটাও হতেই পারে, যদি কোনো টপিক না খুঁজে পাই কথা বলার তাহলে চুপ করে শুধু তাকিয়ে থাকবো তোর দিকে। এভাবেই আস্তে আস্তে বিকেল হয়ে যাবে আমরা তারপর যাবো পার্ক স্ট্রিট, যদি সত্যি কোনো ম্যাজিক হয়ে দুজনের ভাবনা মিলে যায় তখন একটা জিনিস আছে তোকে দেবার যেটা সামনাসামনি হয়তো দিতে পারবো না আমি।"
-" আর যদি ম্যাজিক না হয়, তাহলে তো সেটা আমার না পাওয়াই থেকে যাবে।"
কিছুক্ষণ বাদে রিপ্লাই এলো,
-" থেকে যাবে তো যাবে, সেটার পাওয়ার জন্যই তোকে আজ পুরো চেষ্টা করতে হবে যেনো আমাদের ভাবনা মিলে যায়।"
-" আচ্ছা ঠিকাছে, দেখা যাক কি হয়, আচ্ছা আমি যাই এবার।"
-" হ্যাঁ হ্যাঁ আয়, গুড নাইট, হয়তো খুব তাড়াতাড়ি স্বপ্নে দেখা হবে।"
মুচকি হেসে টাটা বলে ফোনটা চার্জে লাগিয়ে শুতে চলে যায় ঘাসফড়িং। প্রজাপতি যেমন ভাবছে সেরম কিছু হওয়া কি আদৌ সম্ভব? দুটো ভাবনা কীকরে মিলে যেতে পারে? বেশ খানিকটা অবিশ্বাস নিয়ে চাদরটা গায়ের ওপর টেনে নিল সে। ঘড়িতে দেখলো এগারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট। আরো পনেরো মিনিট বাকি, পৌনে বারোটায় না বলে সাড়ে এগারোটা বললেই হতো। মনে মনে সবকটা জায়গা পর পর একটু গুছিয়ে নিতে লাগলো সে, কারণ পর পর ই ভাবতে হবে অর্ডার গুলিয়ে গেলে ম্যাজিক হবে না। অবশ্য অর্ডার ঠিক থাকলেও যে ম্যাজিক কতটা সম্পন্ন হবে সেটাও একটা ভাববার বিষয় বটে। চোখ গেলো ঘড়ির দিকে বারোটা বেজে পঁয়তাল্লিশ। এবার ভাবতে হবে, চোখ বন্ধ করে নিজের তৈরি একটা বাস্তবিক গল্পে ডুবে যেতে লাগলো ঘাসফড়িং।
রবীন্দ্র সরোবরের পাশে একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে ঘাসফড়িং। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে প্রজাপতি। পিছন দিয়ে এসে চোখটা চেপে ধরে বলবে,
-" কীরে, কতক্ষণ ধরে দাড়িয়ে আছিস?"
চোখের ওপর থেকে হাত সরাতে সরাতে সে বললো,
-" এই বেশিক্ষণ নয় মিনিট পাঁচেক হলো।"
-"আচ্ছা তাহলে এখন কি প্ল্যান?"
-" প্ল্যান তো তুইই করেছিস, তোর মনে নেই নাকি?"
ঘাসফড়িং এর দিকে বেশ কিছুটা ঘন হয়ে আসে প্রজাপতি নিজের হাতের মুঠোয় ধরে নেয় ওর হাতটা। যদিও প্রজাপতিকে দিয়ে এসব করাচ্ছে ঘাসফড়িং তার কল্পনার মাধ্যমে। সে এক একটা ঘটনা আগে থেকেই ভেবে নিচ্ছে আর সেটাকে কল্পনা করছে তাদের তৈরি এই গল্পে। মুহূর্তের নৈঃশব্দ্য, তারপর প্রজাপতি বললো,
-" আচ্ছা চল আমরা সরোবরের ধার ধরে একটু হাঁটি গল্প করতে করতে। তারপর যাবো ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল।"
-" আচ্ছা চল।"
চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকা ঘাসফড়িং এর ঠোঁটের কোণে এখন একটা হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। কল্পনার জগতে এখন সে আর প্রজাপতি যে মুহূর্তটা কাটাচ্ছে বাস্তবে এখনও এত সুন্দর মুহূর্ত কাটেনি তাদের। একসাথে তারা কখনো হাঁটেনি তা নয় তবে হাত ধরে হাঁটাটা আর হয়নি। কারণ আর কি, ওই কেউ দেখে ফেললে কি হবে এই ভয়। তবে কল্পনায় তো দেখে ফেলার ভয় নেই কারোরই, তাই এই মুহূর্তে স্বাধীনতাটাই হয়তো সেই বিশেষ অনুভূতির স্বাদ দিচ্ছে তাকে।
-" আচ্ছা এবার তাহলে ভিক্টোরিয়া যাওয়া যাক?" ঘাসফড়িং প্রশ্ন করলো।
-" আমার কোনো অসুবিধে নেই, তবে আমরা কিসে করে যাবো? ট্যাক্সি?"
-" ধুর, কল্পনাতেও ট্যাক্সি করে যাবি? ভালো করে দেখ চারিদিকে।"
প্রজাপতি সামনের দিকে তাকাতেই সকালের সোনালী রোদে ঝলমল করে উঠলো ভিক্টোরিয়ার চূড়োয় দাঁড়িয়ে থাকা পরীটা।
-" না না এভাবে না, পরেরবার ট্যাক্সি বা ট্রামে করেই যাবো, কল্পনা তো কি হয়েছে বাস্তবের ছোঁয়া না থাকলে মজা কোথায় বল।"
-" আচ্ছা, তাই হবে না হয়।"
সামনের দিকে একটা বেঞ্চির দিকে ইশারা করে প্রজাপতি বললো, "চল ওখানটায় গিয়ে বসি একটু।"
দুজনে গিয়ে বসলো বেঞ্চিটায়। বসেই নিজের মাথাটা এলিয়ে দিল সে ঘাসফড়িং এর কাঁধে। ঘাসফড়িং শক্ত করে চেপে ধরলো প্রজাপতির হাতটা।
-" কীরে কিছু বলবি না?" নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলো প্রজাপতি।
-" কী বলবো কিছু বুঝতে পারছি না। তোকে এত কাছে পেয়েও ঠিক মন ভরছে না জানিস। বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে যে এসব দৃশ্যগুলো তো আমারই সাজানো এর ঠিক পড়েই কি ঘটবে সেটাও আমার জানা তাই এত প্রানবন্ত মুহূর্ত গুলোও প্রাণহীন মনে হচ্ছে আমার।"
প্রজাপতি আরো কাছে সরে এসে বললো, "ভালোবাসতে গেলে সবচেয়ে জরুরি কি বলতো?"
-" ভালবাসার মানুষটার ওপর বিশ্বাস রাখা।"
-" শুধু তাই নয়, সাথে ভালোবাসার ওপরেও বিশ্বাস রাখতে হয়। তোর আমাদের ভালবাসার ওপর বিশ্বাস আছে তো?"
-" হুম।"
-" তাহলে সেই ভালোবাসার ওপরেই ভরসা রেখে এগিয়ে চলি না আমরা, দেখি না কি হয়। আর এমনিতেও ইতিহাস সাক্ষী আছে, প্রকৃত যারা ভালোবাসে তারা সহজে একে ওপরের হতে পারেনা, কখনো সখনো তো একে অপরকে নিজের করে পাবার সুযোগটাও থাকেনা তাদের কাছে।"
-" কিন্তু তোকে কাছে পেতে বড্ডো ইচ্ছে করে জানিস, আর ভালো লাগে না এত দূরত্ব। দেখাও তো হয়না সেভাবে আমাদের বল আর তার পরে অনেক কষ্টে একটু দেখা হলেও তোর হাতটা ধরে একটু তোকে কাছে টেনে নেবার সুযোগটুকু পাইনা। হ্যাঁ হয়তো শুধু ভালোবাসলেই, কাউকে কাছে পাওয়া যায়না কিন্তু কি করবো বল মনকে বোঝাই কীকরে, কল্পনা আর বাস্তবের মধ্যে এই বিশাল পার্থক্যটা।"
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে প্রজাপতি, আরেকটা হাত দিয়ে নিজের দু-হাতের মধ্যে বন্দী করে নেয় ঘাসফড়িং এর হাতটা। কেউ আর কোনো কথা বলতে পারে না। পারবে কি করে, ঘাস ফড়িং এর আধো ঘুমন্ত মুখের হাসিটা এখন পরিণত হয়েছে চোখের কোণের অশ্রুধারায়।
একটা অন্য জগতে হারিয়ে গেছিলো ঘাসফড়িং, কোথায়? সেটা নিজেও জানে না সে। কল্পনার জগতে ফিরতে মনে পড়লো তার কল্পনায় ছেদ পড়েছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য তার কাল্পনিক গল্প থেকে হারিয়ে গেছিলো সে, প্রজাপতি আর রৌদ্রালকিত ভিক্টোরিয়া পরিবর্তে জমে এসেছিল এক নিকষ কালো অন্ধকার। সম্বিত ফিরলে আবার অন্ধকারের জাল ছিন্ন করে নিজেকে তার প্রজাপতিকে আর তার গল্পকে খুঁজে বের করে সে। কল্পনার রাশ আলগা করে তাকে বিস্তৃতির দিশা দেখায় ঘাসফড়িং।
তবে আশ্চর্যরকম ভাবে কল্পনার সামান্য অংশ আর ভাবতে পারলো না সে। রেস্ট্রুরেন্টে খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারটা যেনো কিভাবে স্কিপ হয়ে গেছে এখন তারা বসে আছে গড়ের মাঠে। ঠিক যেমন প্রজাপতি বলেছিল সেভাবেই। প্রজাপতির কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে ঘাসফড়িং। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর মাঝে মধ্যে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে প্রজাপতির আঙ্গুলগুলো। দিগন্তরেখার দিকে ক্রমশ ঢলে পড়ছে গলিত লাভার রঙে রাঙিয়ে যাওয়া অস্তগামী সূর্য। ক্রমেই পুবের আকাশে অন্ধকার নেমে আসতে লাগলো গাঢ় নীল বর্ণের ছদ্মবেশে।
-" এবার উঠতে হবে।" বললো প্রজাপতি।
-" এখনই? একটু বাদে গেলে হয়না?"
-" আমাদের তো সময় বাঁধা তাই না? ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় পৌঁছতে না পারলে ম্যাজিক হবে কীকরে?"
আর কোনো কথা না বলে উঠে পড়লো ঘাসফড়িং।
পার্ক স্ট্রিট পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যে হয়ে গেলো, কলকাতার বুকে আজকের দিকে সবচেয়ে প্রাণোচ্ছল জায়গাটা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো দুজনেই। রাস্তার দু ধারে ভিন্ন রকমের আলোর সাজে সেজে উঠেছে গোটা পার্ক স্ট্রিট। চারিদিকে বিভিন্ন বয়সের মানুষ মাথায় স্যান্টা টুপি পরে এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ অ্যালেন পার্কের দিকে। এত মানুষ এত আনন্দের মধ্যেও ঘাসফড়িং কেমন যেনো অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে এখন। প্রজাপতির হাতের মুঠো আলগা হয়ে আসছে ক্রমেই। ঘাসফড়িং যেন হারিয়ে যাচ্ছে কোন এক অচেনা জগতে। এসব কি হচ্ছে সে বুঝতে পারছেনা কিছুই। এতক্ষণ পর্যন্ত সে নিজের কল্পনায় গল্পের সুতো বুনছিল কিন্তু এখন এমন অনেক ঘটনাই ঘটছে যেটা সে ঘটাতে চায়না। এত লোক এতো ভীড় কেনো? এতক্ষণ যা কল্পনা করেছে তাতে প্রজাপতিকে ছাড়া অন্য কোনো মানুষের উপস্থিতিকে সাবলীল ভাবে অগ্রাহ্য করে এসেছে সে। পার্ক স্ট্রিট সম্মন্ধে তার ভাবনাটা যথেষ্ট একইরকম হলেও এতো মানুষের ভিড় আর এত হইচই তো সে কল্পনা করছে না, কল্পনা করতে চাইছে না তাহলে এটা কি হচ্ছে, তার কল্পনায় তার নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই আর।
-" কীরে হাত ছেড়ে দিলি যে?"
ঘাসফড়িং এমন গভীর ভাবনায় ডুবে ছিল যে খেয়ালই করেনি কখন তার হাতটা খসে পড়েছে প্রজাপতির হাতের মুঠো থেকে।
-" এসব কি হচ্ছে রে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।"
-" মানে?" কি বলতে চাইছিস বলতো?"
-" মানে এটা তো আমার ভাবনা আমার তৈরি করা একটা কাল্পনিক গল্প..
-" তোর..কাল্পনিক গল্প?"
প্রজাপতির এই প্রশ্নে বেশ অবাক হয়ে গেলো ঘাসফড়িং। এরম কোনো প্রশ্ন তো করাতে চায়নি সে প্রজাপতিকে দিয়ে। তাকে আরো অবাক করে দিয়ে আকস্মিকভাবে সজোরে জড়িয়ে ধরলো প্রজাপতি তাকে পার্ক স্ট্রিট এর ব্যস্ত রাস্তার মাঝে। ঘাসফড়িং সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে তার কল্পনার ওপর থেকে। প্রজাপতির শরীরের উত্তাপে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে সে। আর ধীরে ধীরে চারিপাশের মানুষগুলো টুকরো টুকরো সোনালী আলোর কণায় পরিণত হয়ে ক্রমশ রঙিন করে তুলছে পার্ক স্ট্রিটের আলোর সমুদ্রকে।
-" এতক্ষণ তো এতকিছু বলছিলি আমায় নিজের করে পেতে চাস কাছে টেনে নিতে চাস, কিন্তু দেখ তুই নিজেই কিন্তু এখনও আমায় তোর কাছে টেনে নিলি না।"
প্রজাপতির কথা শুনে ঘাসফড়িং ও সবকিছু ভুলে জড়িয়ে ধরলো প্রজাপতিকে। একটা সুন্দর গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে লাগল পরিবেশ জুড়ে। আলোয় ঝলমলিয়ে ওঠা শান্ত পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে দাঁড়িয়ে কল্পনা বা বাস্তবকে ভুলে উত্তাপ বিনিময় করছে দুটো শরীর একে অপরকে নিজের করে পাওয়ার আনন্দে।
-" তোকে একটা জিনিস দেব বলেছিলাম, মনে আছে?"
প্রজাপতি ফিসফিস করে বলে ওঠে।
-" হুমম মনে আছে তো, ঐটাই ভাবছিলাম কখন দিবি।"
প্রজাপতির বাঁধন আলগা হয়ে যায়, তার হাত দুটো উঠে আসে ঘাসফড়িং এর গালের ওপর। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া জল মুছিয়ে কপালে হাত বুলিয়ে দেয় সে।
-" কোনোদিনও তোর চোখের দিকে সোজাসুজি তাকাতে পারিনি জানিস, মনের মধ্যে কেমন যেন হয় একটা, ইচ্ছে খুব করে এভাবেই তোর দিকে তাকিয়ে থাকি এক দৃষ্টিতে। কিন্তু পরিস্থিতি আমাদের সহায় হয় না কেনো কে জানে। তুই যেমন আমায় কাছে পেতে চাস আমিও চাই জানিস, ভীষণরকম চাই তোকে আমার কাছে, খুব কাছে। তোর মতো আমিও কল্পনায় গল্প বুনি প্রতি রাতে। তোকে সেখানে কাছের করে পেতে চাই। আজও বুনেছিলাম কিন্তু.."
-" কিন্তু?"
-" জানিনা রে, আজকের গল্পটা অন্যদিনের মতন নয়, তোর এই চোখদুটো, তোর এই ছোঁয়া, আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরা, এগুলো আজ বড্ডো সত্যি লাগছে বড্ডো বাস্তবিক লাগছে। মনে হচ্ছে এটা কোনো কল্পনা নয়। সত্যিকারের বাস্তব ঘটনা। আমি তোকে আজ এসব করতে বলেছিলাম কারণ আমি শুধু চেয়েছিলাম যে যখন আমি তোর কথা ভাববো তুইও যেনো আমার কথা ভাবিস, আমি জানিনা ভালোবাসায় সত্যিই কোনো ম্যাজিক হয় কি না তবে আজ এই মুহূর্তে যা ঘটছে তা আমার কাছে সত্যিই ম্যাজিকের চেয়ে কম কিছু না।"
চোখের কোণ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে প্রজাপতির ও। সযত্নে এবার তা মুছিয়ে দেয় ঘাসফড়িং। নিঃশব্দে একে অপরের দিকে অনেকক্ষন একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে তারা। সহসা প্রজাপতি নিজের দিকে কিছুটা টেনে নেয় ঘাসফড়িংকে, আর ফিসফিসিয়ে বলে, " চোখটা বন্ধ কর একবার, প্লীজ।"
ঘাস ফড়িং কোনো প্রশ্ন করেনা, চোখ বন্ধ করতেই সে অনুভব করে তার ঘাড়ে উষ্ণ দুটো হাতের স্পর্শ আর পরমুহূর্তেই একজোড়া উষ্ণ ঠোঁট এসে ভিজিয়ে তোলে তার এতক্ষণ শীতল হাওয়ায় শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁটদুটিকে। এইমাত্র সারা শরীরে খেলে যাওয়া শিহরণ টের পায় দুজনেই। বহুসময় অপেক্ষারত দুই প্রেমিক প্রেমিকার কল্পনা কোন এক আশ্চর্য ম্যাজিকের বলে বাস্তব হয়ে ওঠে।
ভালোবাসার অনুভূতিটাই আলাদা, কি বলেন? এই যেমন এতক্ষণ যে গল্পটা পড়লেন সেখানে কি সত্যি কখনোই ঘাস ফড়িং এর জায়গায় নিজেকে বসিয়ে নিতে মন চায়নি আপনার? যদি না চেয়ে থাকে তাহলে বুঝবো এটা আমার অক্ষমতা, একটু ক্ষমা ঘেন্না করে দেবেন। আর যদি এর অন্যথা হয়ে থাকে, মানে সত্যিই যদি আপনি নিজেকে ঘাসফড়িং এর জায়গায় বসিয়ে একটা বিশেষ অনুভূতিকে ফিল করে থাকেন তাহলে এক কাজ করে দেখতে পারেন। আপনার ভালবাসার মানুষটিকেও গল্পটি শোনাতে পারেন বা পড়তে বলতে পারেন। আর যদি পারেন তো একবার এই কল্পনা আর বাস্তবের খেলাটা খেলেও দেখুন না, হয়তো একটা সময়ে এসে আপনার সাথেও ঘটে যেতে পারে এমনি কোনো ম্যাজিক।
"ভালোবাসা কী?" এই প্রশ্নের সবথেকে সহজ উত্তর জানতে চাইলে আপনাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষের উত্তর কিছুটা এইরকম হবে যে, "একটা ছেলের আর একটা মেয়ের মধ্যে গড়ে ওঠা শারীরিক ও মানসিক প্রেমই হলো ভালোবাসা।" আবার কিছু মানুষের উত্তর এরম ও হয় যে "দুটো মানুষের একে অপরের প্রতি এক বিশেষ নিঃস্বার্থ অনুভূতি হলো ভালোবাসা।" দুটো সংজ্ঞা আপাতভাবে বেশ একই রকম লাগলেও বাস্তবিক ভিত্তিতে দুটির রকম সম্পূর্ণ ভিন্ন। কি ভাবছেন আজ আপনাদের জন্য ভালোবাসার ক্লাসরুম খুলে বসেছি কি না? হেহে না না সেরকম কোনো মনোবাসনা আমার অন্তত নেই। আর ভালোবাসা যেহেতু এক একজনের কাছে এক এক রকমের তাই আমার ধারণা তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার কোনো মানেই হয়না। তাহলে এখন প্রশ্ন হলো এরম উল্টো পাল্টা বকছি কেনো আজ ? আসলে আমি আজ ভালোবাসার একটা সংজ্ঞা খোঁজার চেষ্টা করছি। কিন্তু এখনও অবধি যতগুলো পেলাম তাদের একটাও আমার মনঃপুত হলো না সবকটাতেই কিছু একটা মিসিং বলে মনে হচ্ছে। এবার কি করা যায় বলুন তো? হ্যাঁ একটা ভালো বুদ্ধি এসেছে মাথায়। যেকোনো সংজ্ঞা বোঝার সহজ উপায় কি বলুন তো? তার উদাহরণগুলোকে সঠিকভাবে বোঝা। চলুন আজ একটা গল্পকে আমরা উদাহরণ বানিয়ে ভালোবাসার সংজ্ঞাটা বোঝার চেষ্টা করি। তবে এ গল্প কিন্তু অন্যান্য প্রেম ভালোবাসার গল্পের মতন নয়। এই গল্পের প্রধান চরিত্র হবেন আপনি, আর দ্বিতীয় চরিত্র হবে আপনার ভালোবাসার মানুষটি, আর যদি বাস্তবে আপনার কোনো ভালোবাসার মানুষ নাই থেকে থাকে তো দ্বিতীয় চরিত্রটিকেই নিজের ভালোবাসার মানুষ করে তুলুন না সমস্যা কি? আচ্ছা সব ই তো হলো কিন্তু প্রধান চরিত্রকে অন্যান্য চরিত্রদের থেকে আলাদা করে আমরা চিনব কীকরে? এতো মহা মুশকিলে পড়া গেলো দেখছি, আচ্ছা আমরা না হয় তার নাম দি ঘাসফড়িং।
ঘাসফড়িং কে দেখতে এই ধরুন খানিকটা আপনারই মতন। আপনি আয়নার সামনে দাঁড়ালে যেমন চেহারা ফুটে উঠবে আয়নায় ঠিক তেমন। আর দ্বিতীয় চরিত্রের নাম দেওয়া যাক প্রজাপতি। প্রজাপতি এর চেহারা ধরুন ওই আপনার ভালোবাসার মানুষটির মতন। আর তেমন কেউ আপনার জীবনে না থাকলে আপনি কল্পনা করে নিন এমন কাউকে যাকে আপনি বাস্তবে কখনো নিজের করে পাবেন না কিন্তু তাকে নিজের করে পাবার ইচ্ছে আপনার মধ্যে প্রবল। দেখি চেষ্টা করে গল্পে কিছু মুহূর্তের জন্যেও যদি সেই মানুষটাকে আপনার করে পাইয়ে দিতে পারি।
রাত দশটা অবধি বসে কলেজের প্রজেক্টটা জাস্ট কমপ্লিট করে যখন ফোনটা নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ টা খুললো ঘাসফড়িং ততক্ষণে প্রজাপতির "ওই" "কীরে" "কী করছিস" এই তিনটে মেসেজ ঢুকে গেছে। ইয়ারফোনটা কানে গুঁজে ঘাসফড়িং রিপ্লাই করলো,
- " এই বসে আছি আর গান শুনবো ভাবছি। তুই?"
-" আমি বসে আছি, বাই দা ওয়ে কি গান শুনবি ভাবছিস?"
- " ভাবনা অন দ্য ওয়ে।"
- " তাহলে একটা গান বলছি, ওটা শোন। আমিও শুনবো তাহলে।"
- " কি গান?"
- "দাঁড়া লিংক পাঠাচ্ছি।"
কিছুক্ষণ পরেই টুং করে একটা মেসেজ এলো। স্ক্রীনের ওপর ভেসে উঠলো একটা লিংক আর তার ওপরে একটা থাম্বনেল লাগানো। তার ওপরে লেখা ডিসেম্বরের শহরে। ঘাসফড়িং গানটা চালিয়ে টাইপ করতে শুরু করলো।
-" এটা আবার কি গান? শুনিনি তো আগে।"
- " আরে শোনই না, গানটা হেব্বি লাগে আমার।"
এতক্ষণ গানের মিউজিক চলছিল এবার লিরিকস শুরু হতেই মন দিয়ে শুনতে লাগলো ঘাসফড়িং।
ডিসেম্বর এর শহরে
চেনা শুভেচ্ছা চেনা সেলফোন,
ডিসেম্বর এর শহরে
সবই নিয়নের বিজ্ঞাপন,
ডিসেম্বর এর শহরে
চেনা বন্ধু চেনা নিকোটিন,
ডিসেম্বরের শহরে
ভালোবাসা যেন পোর্সেলিন….
-" কীরে কেমন গানটা?"
এতক্ষণ চোখ বুজে মন দিয়ে গানটা শুনছিল ঘাসফড়িং, মেসেজের আওয়াজ শুনে ফোনটা হাতে নিল। টুকটুক শব্দ করে আঙ্গুল চলতে লাগলো কীবোর্ডের ওপর।
-" বেশ ভালো, লিরিকস গুলো খুব সুন্দর, তবে রিদিমটা একটু বেটার হলে আরো ভালো লাগতো।"
-" হ্যাঁ প্রথম দিকে গানটা খুব স্লো ঠিকই কিন্তু শেষের দিকটা দুর্দান্ত। খেয়াল রাখবি, 'জানি আলোয় ভিজবে চেনা পার্ক স্ট্রিট' এই লাইনটার থেকে।"
-" আচ্ছা।"
- " আজ বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে কি বল?"
- " ধুর কই ঠান্ডা, অন্যান্য বছর ডিসেম্বরের মধ্যেই এমন শীত পড়ে যায় যে কম্বল থেকে বেরোনো যায়না, এখনও ঠিকমত কম্বল চাপা দেবার মত ঠান্ডাই পড়লো না।"
-" হ্যাঁ সেটা অবশ্য ঠিক।"
কিছুক্ষণ দু দিক থেকেই কোনো মেসেজ আসেনা। এত বকবক করলে যা হয় আর কি, কথার স্টক ফুরিয়ে গেছে, এখন দুতরফে ভাবনা চলছে যে কি বলা যায়।
কিছুক্ষণ পরেই প্রজাপতির দিক থেকেই এলো মেসেজ,
-" এখানটা ভালো করে শোন।"
ঘাসফড়িং আবার গানের দিকে মন দিল,
জানি আলোয় ভিজবে চেনা পার্কস্ট্রিট
তবু ট্যাক্সি ধরবে তুমি এয়ারপোর্ট,
নিয়ে সুটকেস ভর্তি শুণ্যতা
হাতছানি দেয় অন্য শহর..
ঘরে ফেরা তোমার অভ্যাসে নেই,
আর পিছু ডাকা আমার সিলেবাসে নেই;
ফিরে পাওয়া এই শহরের ইতিহাসে নেই,
বিষাদ চিহ্ন সানগ্লাসে নেই..
ডিসেম্বরের শহর থেকে যায় অপেক্ষায়
প্রাক্তন ভালোবাসা নিয়ে, প্রাক্তন কলকাতায়,
ডিসেম্বরের শহর থেকে যায় অপেক্ষায়
প্রাক্তন ভালোবাসা নিয়ে, প্রাক্তন কলকাতায়,
সব শীতের শেষে হয়তো বসন্ত আসেনা,
সম্পর্কের ধ্বংসস্তূপ তোমার আমার,
কলকাতায় ..
-" সিরিয়াসলি দারুন গানটা। কিন্তু তুই কীকরে জানলি যে আমার এই জায়গাটাই চলছে?"
-" আরে আমিও তো শুনছিলাম আর তুই যখন শুনতে শুরু করলি আমিও তখনি চালিয়েছিলাম তাই প্রায় একসাথেই চলছিল দুজনের।"
-" ও আচ্ছা এই ব্যাপার।"
-" হুম, এই ব্যাপার।"
আবার কয়েকমিনিট কোনো মেসেজ নেই, ঘাসফড়িং কিছু একটা লিখতে যাবে তখনি প্রজাপতি টাইপ করছে দেখে থেমে গেলো,
-" আচ্ছা একটা জিনিস আমি অনেকদিন ধরে ভাবছিলাম। একবার ট্রাই করবি?"
ঘাসফড়িং একটু সন্দিহান হয়ে টাইপ করে,
-" কী?"
-" টেলিপ্যাথি জানিস তো?"
-" হ্যাঁ, অন্য মানুষের মনের কথা জেনে নেওয়ার কৌশল।"
-" হ্যাঁ তো অনেকটা এরকমই ব্যাপার একবার আমি শুনেছিলাম কোন একটা ইউটিউব ভিডিওতে যে দুটো আলাদা মানুষ যদি একই সময়ে একই ভাবে একই অবস্থায় খুব মন দিয়ে একে অপরের সাথে একই রকমের একটা মুহূর্তের কথা ভাবে তাহলে নাকি দুজনের ভাবনার স্রোত একে অপরের সাথে মিশে যায় আর দুজনেই একই ঘটনা কল্পনা করতে থাকে।"
-" ওহ আচ্ছা, তো তুই কি বলতে চাইছিস?"
-" আমি বলতে চাইছি যে আমরাও এরম করে দেখবো একবার যে সত্যিই এরম কিছু হয় কি না।"
-" ধুর, এসব কিছু হয়না, কিসব বোকা বোকা ব্যাপার।"
-" এই প্লিজ চল না একবার ট্রাই করি, আর তুই ট্রাই না করে কীকরে বলছিস এসব হয়না। হতেই তো পারে, আর বোকা বোকা তো কি তুই আর আমি ছাড়া এসব আর কে জানতে যাচ্ছে?"
-" তা কেউ জানতে যাচ্ছে না ঠিকই।"
-" হ্যাঁ তো ব্যাস তাহলে আজই করবো হ্যাঁ, তুই তো সাড়ে এগারোটা নাগাদ ঘুমোতে যাবি?"
-" হ্যাঁ তবে আরো একটু লেট হয় ওই পৌনে বারোটা বেজেই যায় প্রায় "
-" আচ্ছা তাহলে আমিও আজ একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়বো। আচ্ছা এবার আসল কথা হলো কি নিয়ে ভাবা যায়?"
-" ভাব, ভেবে বল।"
-" সব কি আমি বলবো নাকি তুইও ভাব।"
-" আচ্ছা তাহলে এক কাজ কর, কাল তো পঁচিশে ডিসেম্বর, আমরা কাল সারাদিন একসাথে ঘুরবো কলকাতার কয়েকটা বিশেষ জায়গায়। আর সন্ধ্যেবেলা একদম লাস্টে যাবো পার্ক স্ট্রিট। কেমন এটা?"
-" বেস্ট! আচ্ছা সাড়ে দশটা তো বাজলো তুই বরং খেয়ে আয় আমি বাকি আরো ছোটখাটো কিছু জিনিস ভাবি একটু। "
-" আচ্ছা ভাবো, আমি খেয়ে আসি।"
আধ ঘন্টা বাদে খেয়ে এসে ঘাসফড়িং দেখলো অনেকগুলো মেসেজ এসেছে প্রজাপতির চ্যাটএ। সে পড়তে শুরু করলো।
-" আচ্ছা তাহলে কোথায় কোথায় যাবো একবার ভেবে নি হ্যাঁ কারণ একই জায়গার কথা ভাবতে হবে তো। তাহলে বরং সকাল 10 টা নাগাদ আমরা প্রথমে যাবো রবীন্দ্র সরোবর। সকাল সকাল লেকের পাশটায় ঘুরতে আমার দারুন লাগে। তুই আর আমি হাঁটবো লেকের পাড় দিয়ে হাত ধরে। সেখানে কিছুক্ষণ থাকার পর যাবো ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে। ওখানে কাছাকাছি কোনো একটা বেঞ্চে বসবো আমরা পাশাপাশি তুই আমার কাঁধে বা আমি তোর কাঁধে মাথা রেখে। অনেক গল্প করবো। তারপর দুপুরে কাছাকাছি কোনো রেস্ট্রুরেন্টে যাবো লাঞ্চ করতে। লাঞ্চ করে একটু গড়ের মাঠে গিয়ে বসবো, তুই বসবি আর আমি তোর কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকবো, বা উল্টোটাও হতেই পারে, যদি কোনো টপিক না খুঁজে পাই কথা বলার তাহলে চুপ করে শুধু তাকিয়ে থাকবো তোর দিকে। এভাবেই আস্তে আস্তে বিকেল হয়ে যাবে আমরা তারপর যাবো পার্ক স্ট্রিট, যদি সত্যি কোনো ম্যাজিক হয়ে দুজনের ভাবনা মিলে যায় তখন একটা জিনিস আছে তোকে দেবার যেটা সামনাসামনি হয়তো দিতে পারবো না আমি।"
-" আর যদি ম্যাজিক না হয়, তাহলে তো সেটা আমার না পাওয়াই থেকে যাবে।"
কিছুক্ষণ বাদে রিপ্লাই এলো,
-" থেকে যাবে তো যাবে, সেটার পাওয়ার জন্যই তোকে আজ পুরো চেষ্টা করতে হবে যেনো আমাদের ভাবনা মিলে যায়।"
-" আচ্ছা ঠিকাছে, দেখা যাক কি হয়, আচ্ছা আমি যাই এবার।"
-" হ্যাঁ হ্যাঁ আয়, গুড নাইট, হয়তো খুব তাড়াতাড়ি স্বপ্নে দেখা হবে।"
মুচকি হেসে টাটা বলে ফোনটা চার্জে লাগিয়ে শুতে চলে যায় ঘাসফড়িং। প্রজাপতি যেমন ভাবছে সেরম কিছু হওয়া কি আদৌ সম্ভব? দুটো ভাবনা কীকরে মিলে যেতে পারে? বেশ খানিকটা অবিশ্বাস নিয়ে চাদরটা গায়ের ওপর টেনে নিল সে। ঘড়িতে দেখলো এগারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট। আরো পনেরো মিনিট বাকি, পৌনে বারোটায় না বলে সাড়ে এগারোটা বললেই হতো। মনে মনে সবকটা জায়গা পর পর একটু গুছিয়ে নিতে লাগলো সে, কারণ পর পর ই ভাবতে হবে অর্ডার গুলিয়ে গেলে ম্যাজিক হবে না। অবশ্য অর্ডার ঠিক থাকলেও যে ম্যাজিক কতটা সম্পন্ন হবে সেটাও একটা ভাববার বিষয় বটে। চোখ গেলো ঘড়ির দিকে বারোটা বেজে পঁয়তাল্লিশ। এবার ভাবতে হবে, চোখ বন্ধ করে নিজের তৈরি একটা বাস্তবিক গল্পে ডুবে যেতে লাগলো ঘাসফড়িং।
রবীন্দ্র সরোবরের পাশে একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে ঘাসফড়িং। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে প্রজাপতি। পিছন দিয়ে এসে চোখটা চেপে ধরে বলবে,
-" কীরে, কতক্ষণ ধরে দাড়িয়ে আছিস?"
চোখের ওপর থেকে হাত সরাতে সরাতে সে বললো,
-" এই বেশিক্ষণ নয় মিনিট পাঁচেক হলো।"
-"আচ্ছা তাহলে এখন কি প্ল্যান?"
-" প্ল্যান তো তুইই করেছিস, তোর মনে নেই নাকি?"
ঘাসফড়িং এর দিকে বেশ কিছুটা ঘন হয়ে আসে প্রজাপতি নিজের হাতের মুঠোয় ধরে নেয় ওর হাতটা। যদিও প্রজাপতিকে দিয়ে এসব করাচ্ছে ঘাসফড়িং তার কল্পনার মাধ্যমে। সে এক একটা ঘটনা আগে থেকেই ভেবে নিচ্ছে আর সেটাকে কল্পনা করছে তাদের তৈরি এই গল্পে। মুহূর্তের নৈঃশব্দ্য, তারপর প্রজাপতি বললো,
-" আচ্ছা চল আমরা সরোবরের ধার ধরে একটু হাঁটি গল্প করতে করতে। তারপর যাবো ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল।"
-" আচ্ছা চল।"
চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকা ঘাসফড়িং এর ঠোঁটের কোণে এখন একটা হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। কল্পনার জগতে এখন সে আর প্রজাপতি যে মুহূর্তটা কাটাচ্ছে বাস্তবে এখনও এত সুন্দর মুহূর্ত কাটেনি তাদের। একসাথে তারা কখনো হাঁটেনি তা নয় তবে হাত ধরে হাঁটাটা আর হয়নি। কারণ আর কি, ওই কেউ দেখে ফেললে কি হবে এই ভয়। তবে কল্পনায় তো দেখে ফেলার ভয় নেই কারোরই, তাই এই মুহূর্তে স্বাধীনতাটাই হয়তো সেই বিশেষ অনুভূতির স্বাদ দিচ্ছে তাকে।
-" আচ্ছা এবার তাহলে ভিক্টোরিয়া যাওয়া যাক?" ঘাসফড়িং প্রশ্ন করলো।
-" আমার কোনো অসুবিধে নেই, তবে আমরা কিসে করে যাবো? ট্যাক্সি?"
-" ধুর, কল্পনাতেও ট্যাক্সি করে যাবি? ভালো করে দেখ চারিদিকে।"
প্রজাপতি সামনের দিকে তাকাতেই সকালের সোনালী রোদে ঝলমল করে উঠলো ভিক্টোরিয়ার চূড়োয় দাঁড়িয়ে থাকা পরীটা।
-" না না এভাবে না, পরেরবার ট্যাক্সি বা ট্রামে করেই যাবো, কল্পনা তো কি হয়েছে বাস্তবের ছোঁয়া না থাকলে মজা কোথায় বল।"
-" আচ্ছা, তাই হবে না হয়।"
সামনের দিকে একটা বেঞ্চির দিকে ইশারা করে প্রজাপতি বললো, "চল ওখানটায় গিয়ে বসি একটু।"
দুজনে গিয়ে বসলো বেঞ্চিটায়। বসেই নিজের মাথাটা এলিয়ে দিল সে ঘাসফড়িং এর কাঁধে। ঘাসফড়িং শক্ত করে চেপে ধরলো প্রজাপতির হাতটা।
-" কীরে কিছু বলবি না?" নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলো প্রজাপতি।
-" কী বলবো কিছু বুঝতে পারছি না। তোকে এত কাছে পেয়েও ঠিক মন ভরছে না জানিস। বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে যে এসব দৃশ্যগুলো তো আমারই সাজানো এর ঠিক পড়েই কি ঘটবে সেটাও আমার জানা তাই এত প্রানবন্ত মুহূর্ত গুলোও প্রাণহীন মনে হচ্ছে আমার।"
প্রজাপতি আরো কাছে সরে এসে বললো, "ভালোবাসতে গেলে সবচেয়ে জরুরি কি বলতো?"
-" ভালবাসার মানুষটার ওপর বিশ্বাস রাখা।"
-" শুধু তাই নয়, সাথে ভালোবাসার ওপরেও বিশ্বাস রাখতে হয়। তোর আমাদের ভালবাসার ওপর বিশ্বাস আছে তো?"
-" হুম।"
-" তাহলে সেই ভালোবাসার ওপরেই ভরসা রেখে এগিয়ে চলি না আমরা, দেখি না কি হয়। আর এমনিতেও ইতিহাস সাক্ষী আছে, প্রকৃত যারা ভালোবাসে তারা সহজে একে ওপরের হতে পারেনা, কখনো সখনো তো একে অপরকে নিজের করে পাবার সুযোগটাও থাকেনা তাদের কাছে।"
-" কিন্তু তোকে কাছে পেতে বড্ডো ইচ্ছে করে জানিস, আর ভালো লাগে না এত দূরত্ব। দেখাও তো হয়না সেভাবে আমাদের বল আর তার পরে অনেক কষ্টে একটু দেখা হলেও তোর হাতটা ধরে একটু তোকে কাছে টেনে নেবার সুযোগটুকু পাইনা। হ্যাঁ হয়তো শুধু ভালোবাসলেই, কাউকে কাছে পাওয়া যায়না কিন্তু কি করবো বল মনকে বোঝাই কীকরে, কল্পনা আর বাস্তবের মধ্যে এই বিশাল পার্থক্যটা।"
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে প্রজাপতি, আরেকটা হাত দিয়ে নিজের দু-হাতের মধ্যে বন্দী করে নেয় ঘাসফড়িং এর হাতটা। কেউ আর কোনো কথা বলতে পারে না। পারবে কি করে, ঘাস ফড়িং এর আধো ঘুমন্ত মুখের হাসিটা এখন পরিণত হয়েছে চোখের কোণের অশ্রুধারায়।
একটা অন্য জগতে হারিয়ে গেছিলো ঘাসফড়িং, কোথায়? সেটা নিজেও জানে না সে। কল্পনার জগতে ফিরতে মনে পড়লো তার কল্পনায় ছেদ পড়েছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য তার কাল্পনিক গল্প থেকে হারিয়ে গেছিলো সে, প্রজাপতি আর রৌদ্রালকিত ভিক্টোরিয়া পরিবর্তে জমে এসেছিল এক নিকষ কালো অন্ধকার। সম্বিত ফিরলে আবার অন্ধকারের জাল ছিন্ন করে নিজেকে তার প্রজাপতিকে আর তার গল্পকে খুঁজে বের করে সে। কল্পনার রাশ আলগা করে তাকে বিস্তৃতির দিশা দেখায় ঘাসফড়িং।
তবে আশ্চর্যরকম ভাবে কল্পনার সামান্য অংশ আর ভাবতে পারলো না সে। রেস্ট্রুরেন্টে খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারটা যেনো কিভাবে স্কিপ হয়ে গেছে এখন তারা বসে আছে গড়ের মাঠে। ঠিক যেমন প্রজাপতি বলেছিল সেভাবেই। প্রজাপতির কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে ঘাসফড়িং। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর মাঝে মধ্যে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে প্রজাপতির আঙ্গুলগুলো। দিগন্তরেখার দিকে ক্রমশ ঢলে পড়ছে গলিত লাভার রঙে রাঙিয়ে যাওয়া অস্তগামী সূর্য। ক্রমেই পুবের আকাশে অন্ধকার নেমে আসতে লাগলো গাঢ় নীল বর্ণের ছদ্মবেশে।
-" এবার উঠতে হবে।" বললো প্রজাপতি।
-" এখনই? একটু বাদে গেলে হয়না?"
-" আমাদের তো সময় বাঁধা তাই না? ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় পৌঁছতে না পারলে ম্যাজিক হবে কীকরে?"
আর কোনো কথা না বলে উঠে পড়লো ঘাসফড়িং।
পার্ক স্ট্রিট পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যে হয়ে গেলো, কলকাতার বুকে আজকের দিকে সবচেয়ে প্রাণোচ্ছল জায়গাটা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো দুজনেই। রাস্তার দু ধারে ভিন্ন রকমের আলোর সাজে সেজে উঠেছে গোটা পার্ক স্ট্রিট। চারিদিকে বিভিন্ন বয়সের মানুষ মাথায় স্যান্টা টুপি পরে এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ অ্যালেন পার্কের দিকে। এত মানুষ এত আনন্দের মধ্যেও ঘাসফড়িং কেমন যেনো অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে এখন। প্রজাপতির হাতের মুঠো আলগা হয়ে আসছে ক্রমেই। ঘাসফড়িং যেন হারিয়ে যাচ্ছে কোন এক অচেনা জগতে। এসব কি হচ্ছে সে বুঝতে পারছেনা কিছুই। এতক্ষণ পর্যন্ত সে নিজের কল্পনায় গল্পের সুতো বুনছিল কিন্তু এখন এমন অনেক ঘটনাই ঘটছে যেটা সে ঘটাতে চায়না। এত লোক এতো ভীড় কেনো? এতক্ষণ যা কল্পনা করেছে তাতে প্রজাপতিকে ছাড়া অন্য কোনো মানুষের উপস্থিতিকে সাবলীল ভাবে অগ্রাহ্য করে এসেছে সে। পার্ক স্ট্রিট সম্মন্ধে তার ভাবনাটা যথেষ্ট একইরকম হলেও এতো মানুষের ভিড় আর এত হইচই তো সে কল্পনা করছে না, কল্পনা করতে চাইছে না তাহলে এটা কি হচ্ছে, তার কল্পনায় তার নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই আর।
-" কীরে হাত ছেড়ে দিলি যে?"
ঘাসফড়িং এমন গভীর ভাবনায় ডুবে ছিল যে খেয়ালই করেনি কখন তার হাতটা খসে পড়েছে প্রজাপতির হাতের মুঠো থেকে।
-" এসব কি হচ্ছে রে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।"
-" মানে?" কি বলতে চাইছিস বলতো?"
-" মানে এটা তো আমার ভাবনা আমার তৈরি করা একটা কাল্পনিক গল্প..
-" তোর..কাল্পনিক গল্প?"
প্রজাপতির এই প্রশ্নে বেশ অবাক হয়ে গেলো ঘাসফড়িং। এরম কোনো প্রশ্ন তো করাতে চায়নি সে প্রজাপতিকে দিয়ে। তাকে আরো অবাক করে দিয়ে আকস্মিকভাবে সজোরে জড়িয়ে ধরলো প্রজাপতি তাকে পার্ক স্ট্রিট এর ব্যস্ত রাস্তার মাঝে। ঘাসফড়িং সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে তার কল্পনার ওপর থেকে। প্রজাপতির শরীরের উত্তাপে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে সে। আর ধীরে ধীরে চারিপাশের মানুষগুলো টুকরো টুকরো সোনালী আলোর কণায় পরিণত হয়ে ক্রমশ রঙিন করে তুলছে পার্ক স্ট্রিটের আলোর সমুদ্রকে।
-" এতক্ষণ তো এতকিছু বলছিলি আমায় নিজের করে পেতে চাস কাছে টেনে নিতে চাস, কিন্তু দেখ তুই নিজেই কিন্তু এখনও আমায় তোর কাছে টেনে নিলি না।"
প্রজাপতির কথা শুনে ঘাসফড়িং ও সবকিছু ভুলে জড়িয়ে ধরলো প্রজাপতিকে। একটা সুন্দর গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে লাগল পরিবেশ জুড়ে। আলোয় ঝলমলিয়ে ওঠা শান্ত পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে দাঁড়িয়ে কল্পনা বা বাস্তবকে ভুলে উত্তাপ বিনিময় করছে দুটো শরীর একে অপরকে নিজের করে পাওয়ার আনন্দে।
-" তোকে একটা জিনিস দেব বলেছিলাম, মনে আছে?"
প্রজাপতি ফিসফিস করে বলে ওঠে।
-" হুমম মনে আছে তো, ঐটাই ভাবছিলাম কখন দিবি।"
প্রজাপতির বাঁধন আলগা হয়ে যায়, তার হাত দুটো উঠে আসে ঘাসফড়িং এর গালের ওপর। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া জল মুছিয়ে কপালে হাত বুলিয়ে দেয় সে।
-" কোনোদিনও তোর চোখের দিকে সোজাসুজি তাকাতে পারিনি জানিস, মনের মধ্যে কেমন যেন হয় একটা, ইচ্ছে খুব করে এভাবেই তোর দিকে তাকিয়ে থাকি এক দৃষ্টিতে। কিন্তু পরিস্থিতি আমাদের সহায় হয় না কেনো কে জানে। তুই যেমন আমায় কাছে পেতে চাস আমিও চাই জানিস, ভীষণরকম চাই তোকে আমার কাছে, খুব কাছে। তোর মতো আমিও কল্পনায় গল্প বুনি প্রতি রাতে। তোকে সেখানে কাছের করে পেতে চাই। আজও বুনেছিলাম কিন্তু.."
-" কিন্তু?"
-" জানিনা রে, আজকের গল্পটা অন্যদিনের মতন নয়, তোর এই চোখদুটো, তোর এই ছোঁয়া, আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরা, এগুলো আজ বড্ডো সত্যি লাগছে বড্ডো বাস্তবিক লাগছে। মনে হচ্ছে এটা কোনো কল্পনা নয়। সত্যিকারের বাস্তব ঘটনা। আমি তোকে আজ এসব করতে বলেছিলাম কারণ আমি শুধু চেয়েছিলাম যে যখন আমি তোর কথা ভাববো তুইও যেনো আমার কথা ভাবিস, আমি জানিনা ভালোবাসায় সত্যিই কোনো ম্যাজিক হয় কি না তবে আজ এই মুহূর্তে যা ঘটছে তা আমার কাছে সত্যিই ম্যাজিকের চেয়ে কম কিছু না।"
চোখের কোণ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে প্রজাপতির ও। সযত্নে এবার তা মুছিয়ে দেয় ঘাসফড়িং। নিঃশব্দে একে অপরের দিকে অনেকক্ষন একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে তারা। সহসা প্রজাপতি নিজের দিকে কিছুটা টেনে নেয় ঘাসফড়িংকে, আর ফিসফিসিয়ে বলে, " চোখটা বন্ধ কর একবার, প্লীজ।"
ঘাস ফড়িং কোনো প্রশ্ন করেনা, চোখ বন্ধ করতেই সে অনুভব করে তার ঘাড়ে উষ্ণ দুটো হাতের স্পর্শ আর পরমুহূর্তেই একজোড়া উষ্ণ ঠোঁট এসে ভিজিয়ে তোলে তার এতক্ষণ শীতল হাওয়ায় শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁটদুটিকে। এইমাত্র সারা শরীরে খেলে যাওয়া শিহরণ টের পায় দুজনেই। বহুসময় অপেক্ষারত দুই প্রেমিক প্রেমিকার কল্পনা কোন এক আশ্চর্য ম্যাজিকের বলে বাস্তব হয়ে ওঠে।
ভালোবাসার অনুভূতিটাই আলাদা, কি বলেন? এই যেমন এতক্ষণ যে গল্পটা পড়লেন সেখানে কি সত্যি কখনোই ঘাস ফড়িং এর জায়গায় নিজেকে বসিয়ে নিতে মন চায়নি আপনার? যদি না চেয়ে থাকে তাহলে বুঝবো এটা আমার অক্ষমতা, একটু ক্ষমা ঘেন্না করে দেবেন। আর যদি এর অন্যথা হয়ে থাকে, মানে সত্যিই যদি আপনি নিজেকে ঘাসফড়িং এর জায়গায় বসিয়ে একটা বিশেষ অনুভূতিকে ফিল করে থাকেন তাহলে এক কাজ করে দেখতে পারেন। আপনার ভালবাসার মানুষটিকেও গল্পটি শোনাতে পারেন বা পড়তে বলতে পারেন। আর যদি পারেন তো একবার এই কল্পনা আর বাস্তবের খেলাটা খেলেও দেখুন না, হয়তো একটা সময়ে এসে আপনার সাথেও ঘটে যেতে পারে এমনি কোনো ম্যাজিক।
Last edited: