Bose Arun
Favoured Frenzy
***** মহুয়া *****
তখন ফেসবুক ছিল না, সোশাল মিডিয়া অরকূট। যথারীতি আমার একটা প্রোফাইল ছিল। মাঝে মাঝে নিজের লেখা কবিতা পোস্ট করি। একদিন আমার একটা খুব রোমান্টিক কবিতা পড়ে আমার ফ্রেন্ড লিস্টের একটি অল্প বয়েসি মেয়ে কমেন্ট করে লিখলো, ওয়েল কাম টু দি ওয়ার্ল্ড অফ ইওথ
উইথ ইওর রোমান্টিক মাইন্ড। তার সংগে লিখলো আপনার কবিতা আমার খুব ভালো লাগে, বিশেষ করে আপনার বৃষ্টির
কবিতা, মনে হয় যেন আমিই ওই বৃষ্টি, ভিজিয়ে দিচ্ছি আপনাকে অঝরধারায়। কমেন্টা পড়ে আমার খুব
মজা লেগেছিল আর মেয়েটির ব্যাপারে খুব কৌতূহলও হয়েছিল। ওর প্রোফাইলটা ভালো করে পড়লাম।
ওর নাম মহুয়া দত্ত। কলকাতা মেডিকাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করে ওখানেই ইন্টার্নশিপ করছে।
তাই প্রফাইলে নাম দিয়েছে ডঃমহুয়া দত্ত। এ্যালবামে অনেক ছবি, অপূর্ব সুন্দরী। টানা টানা চোখ তাকিয়ে
আছে আমার দিকে। ওর ছবি গুলো দেখে মনটা কেমন মিষ্টি হয়ে গেলো। একটা ছবি রয়েছে, কোনো একটা
বিয়ে বাড়িতে তোলা, খুব সুন্দর করে সেজেছে, টানা টানা চোখে আই লাইনার, ঠোঁটে হাল্কা লিপস্টিকের
ওপরে লিপগ্লস ঠোঁট দুটোকে কেমন ভিজে ভিজে দেখাচ্ছে, দেখে আমার শরীরটা কেমন শিরশির করছিল। খোপা বাঁধা চুল, একটা জুঁই এর মালা জড়ানো।
অদ্ভূত ব্যাপার ছবিটা দেখছিলাম আর আমি যেন আমার সারা ঘরে জুঁই ফুলের গন্ধ পাচ্ছিলাম।
আমিও মজা করে আমার কবিতায় ওর কমেন্টের রিপ্লাই দিয়ে লিখলাম, একটি মিষ্টি মেয়ের মিষ্টি কমেন্ট মনটা কে মিষ্টি করে দেয়। তাই এবার থেকে আমার সব কবিতা শুধু তোমার জন্য। বিকেলেই রিপ্লাই পেয়ে গেলাম, সত্যিই! সব কবিতা আমার
জন্য? ইস্ আপনি যখন কবিতা লেখেন তখন যদি আমি আপনার কাছে থাকতে পারতাম কি মজা হতো। আপনি
লিখতেন পড়তেন আর আমি গালে হাত দিয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। আর তারপর যখন অরকূটে পোস্ট করতেন, আমি আমার বন্ধুদের ডেকে দেখাতাম, দেখ এই কবিতা গুলো আমার, শুধুই আমার।
ভরা শ্রাবণ মাস, অঝর ধারে বৃষ্টি ঝোরে চলেছে, কি জানি কেন খালি মহুয়ার মুখটা মনে পরে যাচ্ছে।
আকাশের বুকে আঁকা যেন দেখতে পাচ্ছি ওর দুটো বৃষ্টি ভেজা চোখ আমাকে বলছে লিখবে না কবিতা আমার জন্য? সে দিন ওর বৃষ্টি ভেজা দুটো চোখের অনুরোধ ফেলতে পারি নি। পোস্ট করেছিলাম,
******* বৃষ্টি ******
বৃষ্টি ভেজা মন,বৃষ্টি ভেজা স্বপ্ন
আমিতো তোমাকে কখনো
বৃষ্টিতে ভিজতে দেখিনি …….
কিন্তু তোমার চোখের বৃষ্টিতে
আমি যে দেখেছি আমার কষ্ট
চলো না আজ দুজনে বৃষ্টিতে ভিজি --
আমি বৃষ্টি দেখেছি
আমি বৃষ্টিকে ছুঁয়েছি কিন্তু
তোমার বৃষ্টি ভেজা
মনটাকে ছুঁতে পারিনি ………..
এখনো তোমাকে দেখতে পাই
কোনো বৃষ্টি ঝরা দিনে,
আমার ঘরের জানলায়
তোমার বৃষ্টি ভেজা মুখ,
ছুটে যাই …তুমি হারিয়ে যাও
অঝর বৃষ্টির ধারায় …..
আমি বৃষ্টি দেখেছি..
আমি বৃষ্টিকে ছুঁতে পারিনি
ছুঁয়েছি তোমার
বৃষ্টি ভেজা দুটি চোখ ------
নিচে লিখেছিলাম মহুয়া এই কবিতাটা শুধুই তোমার, শ্রাবনের আকাশে আজ তোমার বৃষ্টি ভেজা চোখ দুটো দেখে আমি নিজেকে আটকাতে পারিনি, তাই আমার এই কবিতাটা তুমি গ্রহণ কোরো। আর আজ থেকে তুমি আমার কাছে মহুয়া নও, তুমি আমার বৃষ্টি, বৃষ্টি বলেই ডাকবো তোমাকে।
বিকেলের ডাকেই ( অর্কূটে) উত্তর পেয়ে গেলাম। উফ্ কি দারুণ, কবিতা টা পড়তে পড়তে সত্যি মনে হচ্ছিল
তোমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজি। জানো এখন আমাদের এখানে বৃষ্টি হয়েই চলেছে। আজ
সকাল থেকে তুমি আমাকে খুব জ্বালিয়েছো। আজ আমার হসপিটালে ইন্ডোর ডিউটি ছিল। ওয়ার্ডে রাউন্ড
দিচ্ছিলাম, পেশেন্ট দেখবো কি খালি তোমার কথা মনে হচ্ছিল। জানো আমি যখন ওয়ার্ডে রাউন্ড দিতে যাই
আমি এপ্রন পরিনা, খুব সুন্দর করে শাড়ি পরে খুব সেজে মিষ্টি মিষ্টি হেসেহেসে পেশেন্ট এটেন্ড করি। পেশেন্টরা আমার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।
হি হি হি জানো আজ একজন মহিলা পেশেন্ট কি বলেছে? বলে ওর ছেলেটা যদি বড় হোতো তাহলে নাকি
আমাকে ওর পুত্রবধূ করে নিত। ইস্ কি শখ বলো, আমার বোলে তুমি আছো।......
আমার প্রোফাইলে আমি কখনো আমার কোনো ছবি রাখি না, আমি মেঘের আড়ালে মেঘদূত হয়ে থাকতেই ভালোবাসি, সবার মনে আমার সম্বন্ধে একটা কৌতুহল বজায় রাখতে আমার খুব মজা লাগে। যাই হোক পরের ডাকে মানে অরকূটে ওর চিঠির রিপ্লাই দিলাম। এখনো মনে আছে লিখেছিলাম, বৃষ্টি তোমার লেখা পড়ে তোমাকে নিয়ে কি করবো বুঝে উঠতে
পারছি না। আমাকে না দেখে এমন কি আমার কোনো ছবিও না দেখে এত ভালোবেসে ফেললে আমাকে? আমিও আজকাল বুঝতে পারছি আমার মনটা পুরটাই তোমার দখলে চলে গেছে। কিছু লিখতে বসলে তোমার মুখটাই ভেসে ওঠে চোখের সামনে। তখন মনে হয় তুমি আমার গা ঘেষে বসে আছো, তোমার শরীরের জুঁই ফুলের গন্ধ তোমার একটু ছোঁয়া আমাকে মাতাল করে দিচ্ছে। তাই আমি দূর থেকে আমার মনের ভালোবাসা টুকুই দিতে পারি যা তুমি আলরেডি নিয়ে নিয়েছো আর দিতে পারি তোমার রাঙা হাতে আমার এই কবিতার ডালী।
**** তুমি যদি বলো ****
তুমি যদি বলো আজ রাতে
চাঁদ আর ডুববে না ,
আঁধারের মাঝে আঁধার এ রাত
আজ আর ফুরোবে না ।
এখনো যে অনেক কথা
মনের মাঝে করে গুনগুন
রাতের আকাশে পূর্নিমা চাঁদ
জোছনা মাখা এনেছে ফাগুন ।
তুমি যদি বলো আঁধার শেষে
গাছেগাছে ফুল আর ফুটবে না ,
তোমাকে না দেখে ঊষার অরুণ
পূব আকাশে আজ উঠবে না ।.
তুমি এলে তবে ভ্রমর গুঞ্জন
ফুলেফুলে শাখা ভরে যাবে ,
প্রজাপতির ডানার রঙ্গেরঙ্গে
পূবের আকাশ রঙ্গিন হবে ।.
তাই বসে আছি, তুমি আসবে কখন
ভালবাসবে আমায় আপন করে ,
উজার করে দেবো মনপ্রান
দু হাতে তোমার অঞ্জলি ভরে ।
জানি না কেন আমার এই কবিতাটার রিপ্লাই দু দিন পরে পেয়েছিলাম আজও বুঝতে পারিনি। মহুয়া লিখেছিল, তোমার কবিতা সহ তোমার মনটাকে আমি দুহাত ভরে গ্রহণ করেছি, সেটা তুমি ভালো করে জানো। তোমাকে আমি কোনো দিন ভুলবো না, ভোলা আমার পক্ষে সম্ভবও নয়। কিন্তু কোনো কারনে আমি অরকূটের প্রোফাইল ক্লোজ করতে বাধ্য হচ্ছি, জানি না আর কথা
হবে কি না কোনো দিন। জানি তুমি অন্তত আমাকে ভুল বুঝবে না। সেই শেষ পোস্ট মহুয়ার আমার প্রোফাইলে। আমিও আর চেষ্টা করিনি ওকে খোঁজার। ইন্টারনেটের ভার্চুয়াল জগতে হাটতে হাটতে কত বন্ধু আসে কত প্রেম ভালোবাসা আসে, আবার হারিয়েও যায়। সেই ভালো, আমিও যে মেঘের আড়ালে মেঘনাদের মতো কাউকে দেখা দিতে চাই না। খালি মাঝে মাঝে মনে পড়ে যায় মহুয়ার সেই প্রথম পোস্ট.... Welcome to the
world of youth with your romantic mind .
( আমার লেখা গল্প " মহুয়া " র
শেষ পর্ব)
দেখতে দেখতে বারোটা বছর কেটে গেছে। ডঃ মহুয়া দত্ত আর নিজের পদবীটা পালটাবার সময়টাও করে
উঠতে পারেনি। এখন মালদা মেডিকাল কলেজ হসপিটালের সুপার। আজকের ডঃ মহুয়া কে দেখলে সেই বারো বছর আগের মহুয়াকে কেউ চিন্তেও পারবে না। সেই বাঘাযতিনের ছটফটে মেয়েটি ডাক্তারি পড়তে গিয়ে মেডিকাল কলেজের সমস্ত ক্লাস মাতিয়ে রাখত। এম বি বি এস কম্পলিট করে মেডিকেল কলেজেই ইন্টার্নশিপ করেছিল। এত মিষ্টি দেখতে ছিল মহুয়া সব জুনিয়ার ডাক্তার রা ওর সাথে ডিউটি করার জন্য মনে মনে স্বপ্ন দেখত। সেই মহুয়া মেডিকাল কলেজে ইন্টার্নসশিপ কম্পলিট করে একটা স্পন্সর জোগাড় করে পাড়ি দিয়েছিলো বিলেতে। ছ বছর ইংল্যান্ড এর কুইনসমেরি ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন থেকে মেডিসিনে পোস্টগ্রাজুয়েট কম্পলিট করে দেশে ফিরে এসে এই
মালদা মেডিকাল কলেজে জয়েন করে। আজ ডঃ মহুয়া দত্ত মালদা মেডিকাল কলেজের সুপার। আজও বিয়ে করে উঠতে পারেনি, এক নম্বর সময়ের অভাবে,কেরিয়ার করতে করতে কখন যে বিয়ের সময়টা পেড়িয়ে গেছে বুঝতেও পারেনি। আর দ্বিতীয় কারন, মনের কোণে পরে থাকা একটা না দেখা স্মৃতি কিছুতেই অন্য কোনো
ছেলের দিকে মনটাকে ঘোরাতে দেয় নি। কিন্তু কি আশ্চর্য যার কথা এত গুলো বছর ভুলতে পারে নি তাকে এক বারের জন্যও চোখে দেখেনি, গলার স্বরও শোনে নি। শুধু নামটা জানতো নীল।.... হাসপাতাল লাগোয়া ছিমছাম কোয়ার্টার মহুয়ার, সামনে একফালি ফুলের বাগান, হাসপাতালের মালী ওই ছোট্ট বাগানটাতে সারা বছর ফুলে ভরিয়ে রাখে। জুঁই ফুল মহুয়ার খুব প্রিয়। আজও মহুয়া বর্ষায় ফোটা ভিজে জুঁই এর মালা সুন্দর করে খোপায় জড়াতে ভালোবাসে।
অনেক দিন হয়ে গেলো ইন্টারনেটের সোশ্যাল মিডিয়ার সাথে আজকের মহুয়ার আর কোনো সম্পর্ক নেই,
অবশ্য এখনতো আর আগের অর্কূট নেই, ফেসবুক। অর্কূটের কথা মনে পরলেই মহুয়ার মনে পরে যায়, কত
কবিতা বৃষ্টির মত ঝোরে পোরতো ওর প্রোফাইলে। একটা দিন নীলের সাথে কথা বলতে না পারলে মনটা ছটফট করতো। মনে আছে নীল ওকে বৃষ্টি বলে ডাকতো। আর একটার পর একটা কবিতা পোস্ট করতো ওর প্রোফাইলে।
অত বড় হাসপাতালের সুপার, সব কিছুইতো মহুয়ার দায়িত্ব। সকাল থেকে এক মুহুর্তের জন্যও নিঃশ্বাস ফেলার
অবসর থাকে না। তার ওপর মাসে দুবার কলকাতা। স্বাস্থ্য ভবনে হাসপাতালের রিপোর্ট দেয়া, মিটিং এসবতো আছেই। কোয়ার্টারে ফিরতে ফিরতে রাত আটটা নটা বেজে যায়।
এবারে শুতে যাবার আগের সময়টুকু মহুয়ার নিজের। ফ্রেস হয়ে চেয়ার নিয়ে বারান্দায় এসে বসে ভাবে সেই
হারিয়ে যাওয়া ছটফটে মেয়েটার কথা।
আজও মনে পরে মেডিকাল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন থাকার দিন গুলোর কথা। ওয়ার্ডে ডিউটি পরলে
খুব সেজেগুজে পেশেন্ট এ্যাটেন্ড করতো। এত সুন্দর মিষ্টি করে সাজতো পেশেন্টরা মুগ্ধ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতো। একদিনতো এক ফিমেল পেশেন্ট ওকে পুত্রবধূ করার প্রপোজালই দিয়ে বসলো। নিজের
মনেই হেসে ফেলে মহুয়া। মাঝে মাঝে মহুয়া ভেবে অবাক হয়, কেন নীলকে ও ভুলতে পারছে না, যাকে কোনো দিন দেখেনি, গলার স্বর পর্যন্ত শোনে নি। কলকাতার কোথায় থাকতো তাও জানত না। শুধু মাত্র ওই অর্কূটের প্রোফাইল টুকু ছাড়া। এই বারো বছরে
এখনো নীলের পাঠানো কবিতাগুলো মনের মাঝে গুনগুন করে আর মহুয়ার মন কল্পনা করতে চেষ্টা করে নীল কেমন দেখতে ছিল আর এই বারো বছর পরে কেমন দেখতে হতে পারে।
কিন্তু মনের কল্পনার রঙে নীলের কোনো ছবিই এঁকে উঠতে পারে না। অদেখা অজানা একটি মানুষের
ভালোবাসা যে মহুয়ার জীবনটাকে এই ভাবে পালটিয়ে দিতে পারে কোনো দিন স্বপ্নেও ভাবে নি মহুয়া।
মনে আছে নীলকে মেডিকাল কলেজ হাসপাতালের কলেজ স্ট্রিট বই মার্কেটের দিকের আউট ডোরে
আসতে বলেছিলো মহুয়া। সেদিন খুব সেজে এসেছিলো মহুয়া ওর অদেখা ভালোবাসার জন্য। সকাল থেকে
কাজল টানা চোখ দুটো হরিনীর মতো ছটফট করেছে আর ক্ষণে ক্ষণে দরজার দিকে তাকিয়েছে। কিন্তু দিন
শেষ হয়ে সাঁঝ বয়ে গেলো, কিন্তু সে এলো না। সেদিন বাড়ি গিয়ে বিছানার ওপর কান্নায় ভেঙ্গে পরেছিল মহুয়া। ভাবতে ভাবতে আজ বারো বছর পরেও চোখ দুটো জলে ভরে উঠছে।
নীল রয়, ২০০৮ সালের ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্যাডারের আই এ এস অফিসার ছয় বছর সেন্ট্রালে লিয়েনে খুব যোগ্যতার সাথে কাজ করে এই দুমাস হোলো কলকাতায় ফিরে এসেছে। নীলের যোগ্যতায় খুশী হয়ে
স্টেট হোম মিনিস্ট্রি ওকে মালদার ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট পোস্টিং দিয়ে মালদাতে পাঠিয়েছে। কারন মালদার
হিলি অঞ্চল থেকে ডান দিক বা দিকে অনেক কিলোমিটার ইন্ডিয়া বাংলা দেশ সীমান্ত। তাই এই অঞ্চলের চোরা কারবারি আর সন্ত্রাসবাদীদের কাজ
কারবারে অতিষ্ঠ রাজ্য সরকার আজ খুব কড়া আই এ এস অফিসার নীল রয়কে ডি.এম করে মালদাতে পাঠিয়েছে। রিটেয়ার্ড বাবা আর ছেলের সংসার নীলের। আজ দেখতে দেখতে চল্লিশ ছুঁই ছঁই বয়েস হয়ে গেছে।
বাবার হাজার বলাতেও নীল বিয়ে করেনি। সেই মহুয়ার বিয়ে বাড়ির ছবিটা, যেখানে মহুয়ার সেই কাজল পরা দুষ্টু দুষ্টু চোখ,সুন্দর করে খোপা বাধা চুলে জুঁই ফুলের মালা জড়ানো যেন বলছে আসবে না আমার কাছে?
নীলকে আর কোনো মেয়ের কথা ভাবতেই দেয়নি। মহুয়ার অর্কূটে পাঠানো সব ছবিগুলো আজো নীল রেখে দিয়েছে ওর ল্যাপটপে।
যখন কোনো কাজ থাকেনা, ছবিগুলো দেখে আর ভাবে কেনো হটাত মহুয়া অর্কূটের প্রোফাইল ক্লোজ করে ওর কাছ থেকে হারিয়ে গেলো।
জীবনের প্রথম ভালোবাসা হতে পারে দূর থেকে কিন্তু মনের মাঝে এমন ভাবে গেথে গেছে ভোলা খুব কঠিন।
তাই আর কোনো অন্য মেয়েকে নিজের জীবন সঙ্গিনী করার কথা ভাবতেও পারেনি নীল।
দিন কেটে যায়, মালদা হাসপাতালের সুপার ডঃ মহুয়া দত্তও শুনেছে ওদের ডিস্ট্রিকে নতুন একজন ডি এম এসেছেন। এবং কড়া হাতে মালদার যত রকম ক্রাইম বন্ধ করছেন। কার কাছ থেকে মহুয়া শুনেছিলো ডি এম
এর নাম নীল রয়। শুনে কেমন চমকে গিয়েছিল, যেন কত চেনা কত মনের মাঝে লুকিয়ে রাখা একটা নাম।
আবার ভাবে এই পৃথিবীতে একই নামের কত মানুষ আছে। কিন্তু কি জানি কেন ডি এম এর নাম টা শুনে
মহুয়ার মনটা খুশী খুশী হয়ে উঠেছিল।
এই ভাবে দিন কাটে রাত আসে, হটাত এই বর্ষায় উত্তর বঙ্গে প্রবল বৃষ্টিতে আশেপাশের সব গ্রাম গুলো বিদ্ধংসী
বন্যার কবলে, তার ওপর ফারাক্কার গেট খুলে দেয়াতে হাজার হাজার মানুষ বন্যার কবলে হাবুডুবু খাচ্ছে।
সরকারি তরফে ডি এম নিজে তদারকি করে শয়েশয়ে মানুষকে রেসকিউ করছেন আর যারা অসুস্থ তাদের মালদা মেডিকাল কলেজ হাসপাতালে পাঠাচ্ছেন। হাসপাতালের সুপার ডঃ মহুয়াও নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে যতটা পারছে চেষ্টা করছে সব শুষ্ঠু ভাবে
চিকিৎসা দেবার। হটাত ডি এম আফিস থেকে খবর এলো, ডি এম নীল রয় কাল হসপিটালে আসছেন
বানভাসি মানুষদের চিকিৎসার কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা দেখতে। পরের দিন হসপিটালে সাজো সাজো
ভাব, সুপার ডঃ মহুয়াও আজ সকাল সকাল হাসপাতালে এসে সব কিছু ঠিক আছে কিনা তদারকি করে নিয়েছে। যথা সময় বেলা এগারোটার সময় সঙ্গে জেলার পুলিশ সুপারকে নিয়ে হাসপাতালে ঢুকলেন ডি এম নীল রয়। সুপার ডঃ মহুয়া ডি এম কে অভ্যর্থনা করার জন্য এগিয়ে গেলে ডি এম নীল ওর মুখের
দিকে তাকিয়ে কেমন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো । অনেক্ষণ মহুয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলো
মানুষের মনের স্বপ্ন কি কখনো সত্যি হতে পারে ? এ কাকে দেখছে? ছবিতে দেখা সেই টানা টানা চোখ সেই মুখ সেই নাক ফরসা গায়ের রঙ শুধু বয়েসটা ছবির তুলনায় কিছুটা বেশি। কত শতবার ছবিতে দেখা ,
হারিয়ে যাওয়া সেই অর্কূটের প্রোফাইল থেকে বেরিয়ে আসা ডঃ মহুয়া দত্ত দাঁড়িয়ে আছে নীলের সামনে।
নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না মালদার দোর্দণ্ড প্রতাপ ডি এম নীল রয়।
সুপার ডঃ মহুয়া দত্ত এই প্রথম দেখলো নতুন ডি এম নীল রয়কে। ঝকঝকে চেহারা বয়েস চল্লিশের আশেপাশে, চোখে সোনালী ফ্রেমের দামী চশমা।
এক কথায় হ্যান্ডসাম পুরুষ। কেমন একটা অদৃশ্য আকর্ষণ অনুভব করছে মহুয়া। সেই অর্কূটে ফেলে আসা নীলকে কোনো দিন দেখেনি কিন্তু কেন যেন খালি মনে হচ্ছে ওর হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা নীল ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যথারীতি ডি এম, সুপার ডঃ মহুয়াকে
নিয়ে সব ঘুরেঘুরে দেখে খুব স্যাটিসফাইড। সঙ্গের অফিসাদের যাযা ইন্সট্রাকশন দেবার দিয়ে মহুয়াকে বললো আপনার সাথে একটু কথা আছে আপনার চেম্বারে চলুন। অবাক বিস্ময়ে মহুয়া দেখলো,চেম্বারে ঢুকে ডি এম নীল রয় দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়ালো, অনেক্ষণ ওর মুখের দিকে
তাকিয়ে আছে,মহুয়াও কেনো জানি নিজেকে সামলাতে পারছেনা। হটাত অনুভব করলো নীল ওর কাধ দুটো
ধরে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে ডাকলো বৃষ্টি। এই ছোট্ট কথাটা কানে যেতেই থরথর করে কেঁপে উঠলো মহুয়ার সারা শরীর। মনে হচ্ছে যেন বারো বছর পেছনে ফেলে আসা অর্কূটের প্রোফাইলের কেউ ওকে ডাকছে বৃষ্টি বলে। আবার মহুয়া শুনতে পেলো, নীল
ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলছে মহুয়া তুমি বলবেনা? Welcome to the world of youth with your romantic mind?
সেদিন মহুয়া নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি, দুহাতে জড়িয়ে ধরে নীলের বুকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে
দিয়েছিলো আর নীলও অনেক ভালোবাসায় দুহাতে মহুয়াকে চেপে ধরে রেখেছিল ওর বুকের মাঝে।
**** ***************************************************
তখন ফেসবুক ছিল না, সোশাল মিডিয়া অরকূট। যথারীতি আমার একটা প্রোফাইল ছিল। মাঝে মাঝে নিজের লেখা কবিতা পোস্ট করি। একদিন আমার একটা খুব রোমান্টিক কবিতা পড়ে আমার ফ্রেন্ড লিস্টের একটি অল্প বয়েসি মেয়ে কমেন্ট করে লিখলো, ওয়েল কাম টু দি ওয়ার্ল্ড অফ ইওথ
উইথ ইওর রোমান্টিক মাইন্ড। তার সংগে লিখলো আপনার কবিতা আমার খুব ভালো লাগে, বিশেষ করে আপনার বৃষ্টির
কবিতা, মনে হয় যেন আমিই ওই বৃষ্টি, ভিজিয়ে দিচ্ছি আপনাকে অঝরধারায়। কমেন্টা পড়ে আমার খুব
মজা লেগেছিল আর মেয়েটির ব্যাপারে খুব কৌতূহলও হয়েছিল। ওর প্রোফাইলটা ভালো করে পড়লাম।
ওর নাম মহুয়া দত্ত। কলকাতা মেডিকাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করে ওখানেই ইন্টার্নশিপ করছে।
তাই প্রফাইলে নাম দিয়েছে ডঃমহুয়া দত্ত। এ্যালবামে অনেক ছবি, অপূর্ব সুন্দরী। টানা টানা চোখ তাকিয়ে
আছে আমার দিকে। ওর ছবি গুলো দেখে মনটা কেমন মিষ্টি হয়ে গেলো। একটা ছবি রয়েছে, কোনো একটা
বিয়ে বাড়িতে তোলা, খুব সুন্দর করে সেজেছে, টানা টানা চোখে আই লাইনার, ঠোঁটে হাল্কা লিপস্টিকের
ওপরে লিপগ্লস ঠোঁট দুটোকে কেমন ভিজে ভিজে দেখাচ্ছে, দেখে আমার শরীরটা কেমন শিরশির করছিল। খোপা বাঁধা চুল, একটা জুঁই এর মালা জড়ানো।
অদ্ভূত ব্যাপার ছবিটা দেখছিলাম আর আমি যেন আমার সারা ঘরে জুঁই ফুলের গন্ধ পাচ্ছিলাম।
আমিও মজা করে আমার কবিতায় ওর কমেন্টের রিপ্লাই দিয়ে লিখলাম, একটি মিষ্টি মেয়ের মিষ্টি কমেন্ট মনটা কে মিষ্টি করে দেয়। তাই এবার থেকে আমার সব কবিতা শুধু তোমার জন্য। বিকেলেই রিপ্লাই পেয়ে গেলাম, সত্যিই! সব কবিতা আমার
জন্য? ইস্ আপনি যখন কবিতা লেখেন তখন যদি আমি আপনার কাছে থাকতে পারতাম কি মজা হতো। আপনি
লিখতেন পড়তেন আর আমি গালে হাত দিয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। আর তারপর যখন অরকূটে পোস্ট করতেন, আমি আমার বন্ধুদের ডেকে দেখাতাম, দেখ এই কবিতা গুলো আমার, শুধুই আমার।
ভরা শ্রাবণ মাস, অঝর ধারে বৃষ্টি ঝোরে চলেছে, কি জানি কেন খালি মহুয়ার মুখটা মনে পরে যাচ্ছে।
আকাশের বুকে আঁকা যেন দেখতে পাচ্ছি ওর দুটো বৃষ্টি ভেজা চোখ আমাকে বলছে লিখবে না কবিতা আমার জন্য? সে দিন ওর বৃষ্টি ভেজা দুটো চোখের অনুরোধ ফেলতে পারি নি। পোস্ট করেছিলাম,
******* বৃষ্টি ******
বৃষ্টি ভেজা মন,বৃষ্টি ভেজা স্বপ্ন
আমিতো তোমাকে কখনো
বৃষ্টিতে ভিজতে দেখিনি …….
কিন্তু তোমার চোখের বৃষ্টিতে
আমি যে দেখেছি আমার কষ্ট
চলো না আজ দুজনে বৃষ্টিতে ভিজি --
আমি বৃষ্টি দেখেছি
আমি বৃষ্টিকে ছুঁয়েছি কিন্তু
তোমার বৃষ্টি ভেজা
মনটাকে ছুঁতে পারিনি ………..
এখনো তোমাকে দেখতে পাই
কোনো বৃষ্টি ঝরা দিনে,
আমার ঘরের জানলায়
তোমার বৃষ্টি ভেজা মুখ,
ছুটে যাই …তুমি হারিয়ে যাও
অঝর বৃষ্টির ধারায় …..
আমি বৃষ্টি দেখেছি..
আমি বৃষ্টিকে ছুঁতে পারিনি
ছুঁয়েছি তোমার
বৃষ্টি ভেজা দুটি চোখ ------
নিচে লিখেছিলাম মহুয়া এই কবিতাটা শুধুই তোমার, শ্রাবনের আকাশে আজ তোমার বৃষ্টি ভেজা চোখ দুটো দেখে আমি নিজেকে আটকাতে পারিনি, তাই আমার এই কবিতাটা তুমি গ্রহণ কোরো। আর আজ থেকে তুমি আমার কাছে মহুয়া নও, তুমি আমার বৃষ্টি, বৃষ্টি বলেই ডাকবো তোমাকে।
বিকেলের ডাকেই ( অর্কূটে) উত্তর পেয়ে গেলাম। উফ্ কি দারুণ, কবিতা টা পড়তে পড়তে সত্যি মনে হচ্ছিল
তোমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজি। জানো এখন আমাদের এখানে বৃষ্টি হয়েই চলেছে। আজ
সকাল থেকে তুমি আমাকে খুব জ্বালিয়েছো। আজ আমার হসপিটালে ইন্ডোর ডিউটি ছিল। ওয়ার্ডে রাউন্ড
দিচ্ছিলাম, পেশেন্ট দেখবো কি খালি তোমার কথা মনে হচ্ছিল। জানো আমি যখন ওয়ার্ডে রাউন্ড দিতে যাই
আমি এপ্রন পরিনা, খুব সুন্দর করে শাড়ি পরে খুব সেজে মিষ্টি মিষ্টি হেসেহেসে পেশেন্ট এটেন্ড করি। পেশেন্টরা আমার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।
হি হি হি জানো আজ একজন মহিলা পেশেন্ট কি বলেছে? বলে ওর ছেলেটা যদি বড় হোতো তাহলে নাকি
আমাকে ওর পুত্রবধূ করে নিত। ইস্ কি শখ বলো, আমার বোলে তুমি আছো।......
আমার প্রোফাইলে আমি কখনো আমার কোনো ছবি রাখি না, আমি মেঘের আড়ালে মেঘদূত হয়ে থাকতেই ভালোবাসি, সবার মনে আমার সম্বন্ধে একটা কৌতুহল বজায় রাখতে আমার খুব মজা লাগে। যাই হোক পরের ডাকে মানে অরকূটে ওর চিঠির রিপ্লাই দিলাম। এখনো মনে আছে লিখেছিলাম, বৃষ্টি তোমার লেখা পড়ে তোমাকে নিয়ে কি করবো বুঝে উঠতে
পারছি না। আমাকে না দেখে এমন কি আমার কোনো ছবিও না দেখে এত ভালোবেসে ফেললে আমাকে? আমিও আজকাল বুঝতে পারছি আমার মনটা পুরটাই তোমার দখলে চলে গেছে। কিছু লিখতে বসলে তোমার মুখটাই ভেসে ওঠে চোখের সামনে। তখন মনে হয় তুমি আমার গা ঘেষে বসে আছো, তোমার শরীরের জুঁই ফুলের গন্ধ তোমার একটু ছোঁয়া আমাকে মাতাল করে দিচ্ছে। তাই আমি দূর থেকে আমার মনের ভালোবাসা টুকুই দিতে পারি যা তুমি আলরেডি নিয়ে নিয়েছো আর দিতে পারি তোমার রাঙা হাতে আমার এই কবিতার ডালী।
**** তুমি যদি বলো ****
তুমি যদি বলো আজ রাতে
চাঁদ আর ডুববে না ,
আঁধারের মাঝে আঁধার এ রাত
আজ আর ফুরোবে না ।
এখনো যে অনেক কথা
মনের মাঝে করে গুনগুন
রাতের আকাশে পূর্নিমা চাঁদ
জোছনা মাখা এনেছে ফাগুন ।
তুমি যদি বলো আঁধার শেষে
গাছেগাছে ফুল আর ফুটবে না ,
তোমাকে না দেখে ঊষার অরুণ
পূব আকাশে আজ উঠবে না ।.
তুমি এলে তবে ভ্রমর গুঞ্জন
ফুলেফুলে শাখা ভরে যাবে ,
প্রজাপতির ডানার রঙ্গেরঙ্গে
পূবের আকাশ রঙ্গিন হবে ।.
তাই বসে আছি, তুমি আসবে কখন
ভালবাসবে আমায় আপন করে ,
উজার করে দেবো মনপ্রান
দু হাতে তোমার অঞ্জলি ভরে ।
জানি না কেন আমার এই কবিতাটার রিপ্লাই দু দিন পরে পেয়েছিলাম আজও বুঝতে পারিনি। মহুয়া লিখেছিল, তোমার কবিতা সহ তোমার মনটাকে আমি দুহাত ভরে গ্রহণ করেছি, সেটা তুমি ভালো করে জানো। তোমাকে আমি কোনো দিন ভুলবো না, ভোলা আমার পক্ষে সম্ভবও নয়। কিন্তু কোনো কারনে আমি অরকূটের প্রোফাইল ক্লোজ করতে বাধ্য হচ্ছি, জানি না আর কথা
হবে কি না কোনো দিন। জানি তুমি অন্তত আমাকে ভুল বুঝবে না। সেই শেষ পোস্ট মহুয়ার আমার প্রোফাইলে। আমিও আর চেষ্টা করিনি ওকে খোঁজার। ইন্টারনেটের ভার্চুয়াল জগতে হাটতে হাটতে কত বন্ধু আসে কত প্রেম ভালোবাসা আসে, আবার হারিয়েও যায়। সেই ভালো, আমিও যে মেঘের আড়ালে মেঘনাদের মতো কাউকে দেখা দিতে চাই না। খালি মাঝে মাঝে মনে পড়ে যায় মহুয়ার সেই প্রথম পোস্ট.... Welcome to the
world of youth with your romantic mind .
( আমার লেখা গল্প " মহুয়া " র
শেষ পর্ব)
দেখতে দেখতে বারোটা বছর কেটে গেছে। ডঃ মহুয়া দত্ত আর নিজের পদবীটা পালটাবার সময়টাও করে
উঠতে পারেনি। এখন মালদা মেডিকাল কলেজ হসপিটালের সুপার। আজকের ডঃ মহুয়া কে দেখলে সেই বারো বছর আগের মহুয়াকে কেউ চিন্তেও পারবে না। সেই বাঘাযতিনের ছটফটে মেয়েটি ডাক্তারি পড়তে গিয়ে মেডিকাল কলেজের সমস্ত ক্লাস মাতিয়ে রাখত। এম বি বি এস কম্পলিট করে মেডিকেল কলেজেই ইন্টার্নশিপ করেছিল। এত মিষ্টি দেখতে ছিল মহুয়া সব জুনিয়ার ডাক্তার রা ওর সাথে ডিউটি করার জন্য মনে মনে স্বপ্ন দেখত। সেই মহুয়া মেডিকাল কলেজে ইন্টার্নসশিপ কম্পলিট করে একটা স্পন্সর জোগাড় করে পাড়ি দিয়েছিলো বিলেতে। ছ বছর ইংল্যান্ড এর কুইনসমেরি ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন থেকে মেডিসিনে পোস্টগ্রাজুয়েট কম্পলিট করে দেশে ফিরে এসে এই
মালদা মেডিকাল কলেজে জয়েন করে। আজ ডঃ মহুয়া দত্ত মালদা মেডিকাল কলেজের সুপার। আজও বিয়ে করে উঠতে পারেনি, এক নম্বর সময়ের অভাবে,কেরিয়ার করতে করতে কখন যে বিয়ের সময়টা পেড়িয়ে গেছে বুঝতেও পারেনি। আর দ্বিতীয় কারন, মনের কোণে পরে থাকা একটা না দেখা স্মৃতি কিছুতেই অন্য কোনো
ছেলের দিকে মনটাকে ঘোরাতে দেয় নি। কিন্তু কি আশ্চর্য যার কথা এত গুলো বছর ভুলতে পারে নি তাকে এক বারের জন্যও চোখে দেখেনি, গলার স্বরও শোনে নি। শুধু নামটা জানতো নীল।.... হাসপাতাল লাগোয়া ছিমছাম কোয়ার্টার মহুয়ার, সামনে একফালি ফুলের বাগান, হাসপাতালের মালী ওই ছোট্ট বাগানটাতে সারা বছর ফুলে ভরিয়ে রাখে। জুঁই ফুল মহুয়ার খুব প্রিয়। আজও মহুয়া বর্ষায় ফোটা ভিজে জুঁই এর মালা সুন্দর করে খোপায় জড়াতে ভালোবাসে।
অনেক দিন হয়ে গেলো ইন্টারনেটের সোশ্যাল মিডিয়ার সাথে আজকের মহুয়ার আর কোনো সম্পর্ক নেই,
অবশ্য এখনতো আর আগের অর্কূট নেই, ফেসবুক। অর্কূটের কথা মনে পরলেই মহুয়ার মনে পরে যায়, কত
কবিতা বৃষ্টির মত ঝোরে পোরতো ওর প্রোফাইলে। একটা দিন নীলের সাথে কথা বলতে না পারলে মনটা ছটফট করতো। মনে আছে নীল ওকে বৃষ্টি বলে ডাকতো। আর একটার পর একটা কবিতা পোস্ট করতো ওর প্রোফাইলে।
অত বড় হাসপাতালের সুপার, সব কিছুইতো মহুয়ার দায়িত্ব। সকাল থেকে এক মুহুর্তের জন্যও নিঃশ্বাস ফেলার
অবসর থাকে না। তার ওপর মাসে দুবার কলকাতা। স্বাস্থ্য ভবনে হাসপাতালের রিপোর্ট দেয়া, মিটিং এসবতো আছেই। কোয়ার্টারে ফিরতে ফিরতে রাত আটটা নটা বেজে যায়।
এবারে শুতে যাবার আগের সময়টুকু মহুয়ার নিজের। ফ্রেস হয়ে চেয়ার নিয়ে বারান্দায় এসে বসে ভাবে সেই
হারিয়ে যাওয়া ছটফটে মেয়েটার কথা।
আজও মনে পরে মেডিকাল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন থাকার দিন গুলোর কথা। ওয়ার্ডে ডিউটি পরলে
খুব সেজেগুজে পেশেন্ট এ্যাটেন্ড করতো। এত সুন্দর মিষ্টি করে সাজতো পেশেন্টরা মুগ্ধ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতো। একদিনতো এক ফিমেল পেশেন্ট ওকে পুত্রবধূ করার প্রপোজালই দিয়ে বসলো। নিজের
মনেই হেসে ফেলে মহুয়া। মাঝে মাঝে মহুয়া ভেবে অবাক হয়, কেন নীলকে ও ভুলতে পারছে না, যাকে কোনো দিন দেখেনি, গলার স্বর পর্যন্ত শোনে নি। কলকাতার কোথায় থাকতো তাও জানত না। শুধু মাত্র ওই অর্কূটের প্রোফাইল টুকু ছাড়া। এই বারো বছরে
এখনো নীলের পাঠানো কবিতাগুলো মনের মাঝে গুনগুন করে আর মহুয়ার মন কল্পনা করতে চেষ্টা করে নীল কেমন দেখতে ছিল আর এই বারো বছর পরে কেমন দেখতে হতে পারে।
কিন্তু মনের কল্পনার রঙে নীলের কোনো ছবিই এঁকে উঠতে পারে না। অদেখা অজানা একটি মানুষের
ভালোবাসা যে মহুয়ার জীবনটাকে এই ভাবে পালটিয়ে দিতে পারে কোনো দিন স্বপ্নেও ভাবে নি মহুয়া।
মনে আছে নীলকে মেডিকাল কলেজ হাসপাতালের কলেজ স্ট্রিট বই মার্কেটের দিকের আউট ডোরে
আসতে বলেছিলো মহুয়া। সেদিন খুব সেজে এসেছিলো মহুয়া ওর অদেখা ভালোবাসার জন্য। সকাল থেকে
কাজল টানা চোখ দুটো হরিনীর মতো ছটফট করেছে আর ক্ষণে ক্ষণে দরজার দিকে তাকিয়েছে। কিন্তু দিন
শেষ হয়ে সাঁঝ বয়ে গেলো, কিন্তু সে এলো না। সেদিন বাড়ি গিয়ে বিছানার ওপর কান্নায় ভেঙ্গে পরেছিল মহুয়া। ভাবতে ভাবতে আজ বারো বছর পরেও চোখ দুটো জলে ভরে উঠছে।
নীল রয়, ২০০৮ সালের ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্যাডারের আই এ এস অফিসার ছয় বছর সেন্ট্রালে লিয়েনে খুব যোগ্যতার সাথে কাজ করে এই দুমাস হোলো কলকাতায় ফিরে এসেছে। নীলের যোগ্যতায় খুশী হয়ে
স্টেট হোম মিনিস্ট্রি ওকে মালদার ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট পোস্টিং দিয়ে মালদাতে পাঠিয়েছে। কারন মালদার
হিলি অঞ্চল থেকে ডান দিক বা দিকে অনেক কিলোমিটার ইন্ডিয়া বাংলা দেশ সীমান্ত। তাই এই অঞ্চলের চোরা কারবারি আর সন্ত্রাসবাদীদের কাজ
কারবারে অতিষ্ঠ রাজ্য সরকার আজ খুব কড়া আই এ এস অফিসার নীল রয়কে ডি.এম করে মালদাতে পাঠিয়েছে। রিটেয়ার্ড বাবা আর ছেলের সংসার নীলের। আজ দেখতে দেখতে চল্লিশ ছুঁই ছঁই বয়েস হয়ে গেছে।
বাবার হাজার বলাতেও নীল বিয়ে করেনি। সেই মহুয়ার বিয়ে বাড়ির ছবিটা, যেখানে মহুয়ার সেই কাজল পরা দুষ্টু দুষ্টু চোখ,সুন্দর করে খোপা বাধা চুলে জুঁই ফুলের মালা জড়ানো যেন বলছে আসবে না আমার কাছে?
নীলকে আর কোনো মেয়ের কথা ভাবতেই দেয়নি। মহুয়ার অর্কূটে পাঠানো সব ছবিগুলো আজো নীল রেখে দিয়েছে ওর ল্যাপটপে।
যখন কোনো কাজ থাকেনা, ছবিগুলো দেখে আর ভাবে কেনো হটাত মহুয়া অর্কূটের প্রোফাইল ক্লোজ করে ওর কাছ থেকে হারিয়ে গেলো।
জীবনের প্রথম ভালোবাসা হতে পারে দূর থেকে কিন্তু মনের মাঝে এমন ভাবে গেথে গেছে ভোলা খুব কঠিন।
তাই আর কোনো অন্য মেয়েকে নিজের জীবন সঙ্গিনী করার কথা ভাবতেও পারেনি নীল।
দিন কেটে যায়, মালদা হাসপাতালের সুপার ডঃ মহুয়া দত্তও শুনেছে ওদের ডিস্ট্রিকে নতুন একজন ডি এম এসেছেন। এবং কড়া হাতে মালদার যত রকম ক্রাইম বন্ধ করছেন। কার কাছ থেকে মহুয়া শুনেছিলো ডি এম
এর নাম নীল রয়। শুনে কেমন চমকে গিয়েছিল, যেন কত চেনা কত মনের মাঝে লুকিয়ে রাখা একটা নাম।
আবার ভাবে এই পৃথিবীতে একই নামের কত মানুষ আছে। কিন্তু কি জানি কেন ডি এম এর নাম টা শুনে
মহুয়ার মনটা খুশী খুশী হয়ে উঠেছিল।
এই ভাবে দিন কাটে রাত আসে, হটাত এই বর্ষায় উত্তর বঙ্গে প্রবল বৃষ্টিতে আশেপাশের সব গ্রাম গুলো বিদ্ধংসী
বন্যার কবলে, তার ওপর ফারাক্কার গেট খুলে দেয়াতে হাজার হাজার মানুষ বন্যার কবলে হাবুডুবু খাচ্ছে।
সরকারি তরফে ডি এম নিজে তদারকি করে শয়েশয়ে মানুষকে রেসকিউ করছেন আর যারা অসুস্থ তাদের মালদা মেডিকাল কলেজ হাসপাতালে পাঠাচ্ছেন। হাসপাতালের সুপার ডঃ মহুয়াও নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে যতটা পারছে চেষ্টা করছে সব শুষ্ঠু ভাবে
চিকিৎসা দেবার। হটাত ডি এম আফিস থেকে খবর এলো, ডি এম নীল রয় কাল হসপিটালে আসছেন
বানভাসি মানুষদের চিকিৎসার কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা দেখতে। পরের দিন হসপিটালে সাজো সাজো
ভাব, সুপার ডঃ মহুয়াও আজ সকাল সকাল হাসপাতালে এসে সব কিছু ঠিক আছে কিনা তদারকি করে নিয়েছে। যথা সময় বেলা এগারোটার সময় সঙ্গে জেলার পুলিশ সুপারকে নিয়ে হাসপাতালে ঢুকলেন ডি এম নীল রয়। সুপার ডঃ মহুয়া ডি এম কে অভ্যর্থনা করার জন্য এগিয়ে গেলে ডি এম নীল ওর মুখের
দিকে তাকিয়ে কেমন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো । অনেক্ষণ মহুয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলো
মানুষের মনের স্বপ্ন কি কখনো সত্যি হতে পারে ? এ কাকে দেখছে? ছবিতে দেখা সেই টানা টানা চোখ সেই মুখ সেই নাক ফরসা গায়ের রঙ শুধু বয়েসটা ছবির তুলনায় কিছুটা বেশি। কত শতবার ছবিতে দেখা ,
হারিয়ে যাওয়া সেই অর্কূটের প্রোফাইল থেকে বেরিয়ে আসা ডঃ মহুয়া দত্ত দাঁড়িয়ে আছে নীলের সামনে।
নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না মালদার দোর্দণ্ড প্রতাপ ডি এম নীল রয়।
সুপার ডঃ মহুয়া দত্ত এই প্রথম দেখলো নতুন ডি এম নীল রয়কে। ঝকঝকে চেহারা বয়েস চল্লিশের আশেপাশে, চোখে সোনালী ফ্রেমের দামী চশমা।
এক কথায় হ্যান্ডসাম পুরুষ। কেমন একটা অদৃশ্য আকর্ষণ অনুভব করছে মহুয়া। সেই অর্কূটে ফেলে আসা নীলকে কোনো দিন দেখেনি কিন্তু কেন যেন খালি মনে হচ্ছে ওর হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা নীল ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যথারীতি ডি এম, সুপার ডঃ মহুয়াকে
নিয়ে সব ঘুরেঘুরে দেখে খুব স্যাটিসফাইড। সঙ্গের অফিসাদের যাযা ইন্সট্রাকশন দেবার দিয়ে মহুয়াকে বললো আপনার সাথে একটু কথা আছে আপনার চেম্বারে চলুন। অবাক বিস্ময়ে মহুয়া দেখলো,চেম্বারে ঢুকে ডি এম নীল রয় দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়ালো, অনেক্ষণ ওর মুখের দিকে
তাকিয়ে আছে,মহুয়াও কেনো জানি নিজেকে সামলাতে পারছেনা। হটাত অনুভব করলো নীল ওর কাধ দুটো
ধরে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে ডাকলো বৃষ্টি। এই ছোট্ট কথাটা কানে যেতেই থরথর করে কেঁপে উঠলো মহুয়ার সারা শরীর। মনে হচ্ছে যেন বারো বছর পেছনে ফেলে আসা অর্কূটের প্রোফাইলের কেউ ওকে ডাকছে বৃষ্টি বলে। আবার মহুয়া শুনতে পেলো, নীল
ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলছে মহুয়া তুমি বলবেনা? Welcome to the world of youth with your romantic mind?
সেদিন মহুয়া নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি, দুহাতে জড়িয়ে ধরে নীলের বুকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে
দিয়েছিলো আর নীলও অনেক ভালোবাসায় দুহাতে মহুয়াকে চেপে ধরে রেখেছিল ওর বুকের মাঝে।
**** ***************************************************