বাচ্চাদের প্রচন্ড হইচই শোনা যাচ্ছে। টিফিন টাইম এখন। আমি জেন্টস টিচার্স রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছি। সকাল থেকে ৩টা ক্লাস নিয়েছি। আর চলছে না গলা। কানে বাচ্চাদের মাছির মত গুনগুন আসছেই। যদিও ওরা অনেক দূরে রয়েছে এখান থেকে। তবুও এই বয়সে ওদের উদ্দীপনার কোনও কমতি নেই। ইস আমারও যদি এরকম উদ্দীপনা থাকতো…
আমার ভাল নাম জীবনানন্দ। আমার জীবনে অনেক আনন্দ থাকবে ভেবেই হয়তো মা বাবা শখ করে এই নাম রেখেছিল। কি পরিহাস… রবীন্দ্রনাথের সুভাষিনী ছিল বোবা, আর আমি জীবনানন্দ হলাম জীবনকষ্ট? এরকম শব্দ আদৌ আছে কি না কে জানে। মোদ্দা কথা, জীবনে কষ্টের শেষ নেই।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া বাতাসে ভাসিয়ে দিলাম। চোখের সামনে ভাদ্রের প্রকৃতি ঝাপসা হয়ে আসছে। না আমি কাঁদছি না। সিগারেটের ধোঁয়ায়। একটু আগেই বৃষ্টি হচ্ছিল। এখন রোদ ঝলমল করছে। সামনের কাঠগোলাপ গাছটাকে মাত্র স্নান সেরে আসা উনিশ বছর বয়সী তরুণীর মত দেখাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে গেলাম। গতকাল রাতের ঘটনাটা… ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়ার সুযোগ হবে এই ঘটনার জন্য, কাল রাতে ভাবি নি।
দেখছি আমার দু হাত দড়ি দিয়ে বাধা। আমি গামছাটা গলায় পেচিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলছি। কেউ জোড় করেনি। স্বেচ্ছায় ঝুলছি ফ্যানে।
বাপ মা খুব ভালবাসতো আমাকে। প্রচুর কষ্ট করেছেন তারা সারাটা জীবন। আমার জন্য করেন নি এমন কিচ্ছু নেই জীবনে। বাবা প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। স্বপ্ন ছিল ছেলেকে শিক্ষক বানাবেন তাঁরই মত। তাঁরই মত সবাই তাঁর ছেলেকে সম্মান করবে। বাবার সেই স্বপ্নকে সত্যি করতেই আমার কলেজের শিক্ষক হওয়া। কিন্তু আহারে জীবন। বাবা সারাজীবন কষ্ট করেছেন সরকারি প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার হিসেবে, আমি বাকি জীবনটা কষ্ট করে যাব এই সরকারি কলেজের প্রভাষক হিসেবে। এই বেতনে জীবন চলে নাকি আজকাল?
বাবা আমার কাছে কখনও কিচ্ছু চান নি। শুধু এই একটা জিনিসই চেয়েছিলেন, আমি যেন কলেজের শিক্ষক হই। আমি বাবার স্বপ্ন পূরণ করতেই এখানে এসেছি। কিন্তু শহরে থেকে বাবা, মা, আমি আমাদের তিনজনের সংসার বাড়িভাড়া দিয়ে এই সরকারি স্কুলের বেতনে আর চলছে না। আমি ছেলেবেলা থেকেই ব্যবসা করতে চাইতাম। কিন্তু কখনও বাবাকে বলতে পারি নি। ভেবে নিয়েছিলাম একটা কিছু উপায় করবই। কলেজের যে বেতন তা দিয়ে মোটেও তেমন কিছু জমাতে পারি না। ব্যাংক ব্যালেন্স বলতে গেলে নেই ই। আর এতো ক্লাস নিয়েও আর অন্য কাজে মন দেয়া যায় না।
অনেক ভাবনা চিন্তা করে তাই তিন মাস আগে গ্রামের দিকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অল্প একটা জমি লিজ নিয়েছিলাম ৫ বছরের জন্য। সেখানে ঘর তুলেছি একটা। টাকা দিয়ে একটা লোক রেখেছি সেখানে। উদ্দেশ্য খামার করা। এটুকুতেই আমার সব পয়সা শেষ। গ্রামের এক সমিতি থেকে তাই চড়া সুদে ধার করেছি কিছু। ৪টা দুধ দেওয়া গাভী কিনেছি। ভালই চলছিল। গাভীর দুধ বিক্রি করে ধারের টাকা শোধ করছি। কিন্তু জীবনানন্দ মজেছিল বাংলার প্রকৃতিতে, বনলতায় নয়। সেটা তো আমরা হামেশাই ভুলে যাই।
এবারের বর্ষায় এতো বৃষ্টি হল, হুট করে বাধ ভেঙে পুরো গ্রামটা রাতারাতি তলিয়ে যাবে কে ভাবতে পেরেছিল। দিন পনেরো আগে এক রাতে হুট করে গ্রামটার নদীর বাধ ভেঙে যায়। তেমন সমস্যা হত তার পরেও। আমার গোয়ালঘর ডুবে গেলেও গরুগুলো সাঁতরে বাঁচবে ভেবেছিলাম। গরুর গলায় যে দড়ি বাধা ছিল মনেই নেই আমার। অনভিজ্ঞতার দরুন নিচু জমিতে খামার করে মাত্র ৬ ইঞ্চির জন্য গরুগুলো ডুবে মরে এক রাতেই। পেট ভেসে রয়েছে অথচ মাথা পানির নিচে। রাতারাতি পানির নিচে তলিয়ে গেল আমার বিদেশী জাতের গরুগুলো। আমার ১০ লক্ষ্য টাকা।
আমার ১৫ হাজার টাকা বেতনের চাকরিতে আমি পুষিয়ে উঠতে পারব না কখনও এই ঋণ। গত ১৫টা দিন ধরে ঘুমোতে পারি নি। চাকরিটা আছে এখনও। তবুও লাভ কি? কিস্তি দেব কি করে? আমার ছটফটানো আমার মা বুঝে। বুঝে আমি চাপ এ আছি। কিছু জানে না সে তাও কিভাবে যেন সব বুঝে যায়। কাল রাতে ভাত খাওয়ার পর আমি শুয়ে আছি বিছানায় সিলিং ফ্যানের দিকে চেয়ে, চিত হয়ে। মা আমার ঘরে এসেছিলেন। কিছু বলেন নি আমাকে। শুধু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গেলেন কয়েকবার।
মায়ের চোখে কি আমি জল দেখলাম? জানি না। মাথাটা ওলোটপালোট লাগছে। নিজেকে অপ্রকৃতস্থ লাগছে খুব। অনেক দিন পর অভিদা মানে আমার বড়দা কে খুব মিস করছি। বাড়ির অমতে বিয়ে করে উনি আজ ১২ বছর ফ্যামিলির বাইরে। কোথায় আছেন জানি না। যোগাযোগ নেই। বড়দাটা থাকলে ঠিক আমায় উদ্ধার করে নিতো আমায়। বাবাকে বলতে পারব না। মায়ের চোখের জল আর সহ্য হচ্ছে না। কি ভাবতে ভাবতে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালাম আমার ঘরের। বারান্দায় দড়িতে আমার পুরোনো গামছাটা শুকোচ্ছে। রাত ১২.৩০। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। সালার এই বৃষ্টির জন্যই ফাঁস লেগে মরে গেল আমার স্বপ্নগুলো। ছিঁড়ে গেল আমার স্বপ্নগুলো।
ভাবতে ভাবতে চোখ গেল গামছাটায়। লোডশেডীং। ফ্যান অফ। গরম লাগছে। গামছাটার একটা কোনা ছিঁড়ে একটা ফাঁস বানিয়ে নিজের হাত বেঁধে নিলাম। এরপর গামছার বাকি অংশ দিয়ে আরেকটা ফাঁস বানিয়ে সেটা গলায় দিয়েই পাখার সাথে ঝুলে পড়লাম।
হাত বেধেছি কারণ আমার ধারণা ছিল হাত খোলা থাকলে শেষ মুহূর্তে আমি নিজের হাতে ফাঁস খুলে ফেলব। মাথায় সব ফ্ল্যাশব্যাক চলছে। পুরো জীবনের ফ্ল্যাশব্যাক। বাবা, মা, অভিদা, বৌদি, পাড়ার ছোটোভাই রঞ্জন। সব। কালকে ক্লাসের লেকচার রেডি নেই তাও মাথায় এলো। কি লাভ। কাল থেকে আর ক্লাস ই নেওয়া লাগবে না আমার। সব শেষ।
কেমন যেন টান লাগছে গলায়। চড়চড় শব্দ পাচ্ছি, গলার রগ ছিঁড়ে যাচ্ছে নাকি? ভাবতে ভাবতেই দুম করে পুরো পৃথিবীটা আমার উপর এসে আছড়ে পড়ল। আমি পৃথিবীর উপর আছড়ে পড়লাম বলা ভাল। মাজায় ব্যাথা পেয়েছি। অন্ধকারে বুঝছিলাম না কি ঘটেছে। হঠাৎ খুব হাসি পেল।
মা বারবার বলছিল, গামছাটা পুরোনো হয়ে গেছে পালটে নিতে। আমি কিনবো কিনছি বলে আর কিনি নি। সেই পুরোনো গামছাই গলায় দিয়ে সুইসাইড এটেম্পট করেছিলাম। গামছাটা ছিঁড়ে পড়েছি মাটিতে।
উঠে বারান্দায় গিয়ে দাড়িয়েছিলাম। হাত বাইরে বাড়িয়ে দিয়ে হাত ভেজাচ্ছি বৃষ্টিতে। ছোটবেলায় বৃষ্টি হলে মা বাইরে খেলতে যেতে দিত না আমাকে আর অভিদাকে। তখন এভাবে কত দাঁড়িয়ে থেকে হাত ভিজিয়েছি।
অভিদা আমাকে প্রায়ই বলতো, “টিকে থাক ছোট। এই তো আর একটু খানি। এই পৃথিবীতে মানুষের আসার উদ্দেশ্য হচ্ছে যতটুকু সম্ভব বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যা ভাই। দেখবি একটা নতুন দিন ঠিক আসবে। মনে রাখবি, একটা নবজাতক শিশুর ও এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে তার মায়ের দরকার নেই। স্রষ্টা চাইলে সে বেঁচে থাকবেই। তোর চিন্তা করবেন স্রষ্টা। তুই শুধু হাল ছাড়িস না।“
পাশে অভিদাকে মিস করছিলাম খুব।
ঘন্টার শব্দ শুনে বাস্তবে ফিরে এলাম। টিফিনটাইম শেষ। ক্লাস নিতে হবে। ভেবেছিলাম আর লেকচার দেওয়া লাগবে না তাই লেকচার রেডি করি নি। আমার কান্ড দেখিয়া মেঘের আড়ালে বসিয়া হাসেন অন্তর্যামী। আজই আমি আবারও লেকচার ছাড়া ক্লাস নেব।
সিগারেটটা এশট্রেতে পিষতে পিষতে ভাবলাম, আর হাল ছাড়ব না। ঘুড়ে দাঁড়াবোই আমি। বাপ মার রাখা নামের স্বার্থকতা ছাড়া আমি মরব না। এরপর অভিদার ভাষায়, বেঁচে থেকে মরে যাবার স্বার্থক একটা গল্প তৈরি করব।
কাঁথা ছিঁড়ে গেলে আমরা তা ফেলে দিই না। তাতে জোড়াতালি দেই। এরপর তা মুড়ি দিয়ে দেখি আমাদের ছেঁড়াফাটা স্বপ্নগুলি।
আমার ভাল নাম জীবনানন্দ। আমার জীবনে অনেক আনন্দ থাকবে ভেবেই হয়তো মা বাবা শখ করে এই নাম রেখেছিল। কি পরিহাস… রবীন্দ্রনাথের সুভাষিনী ছিল বোবা, আর আমি জীবনানন্দ হলাম জীবনকষ্ট? এরকম শব্দ আদৌ আছে কি না কে জানে। মোদ্দা কথা, জীবনে কষ্টের শেষ নেই।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া বাতাসে ভাসিয়ে দিলাম। চোখের সামনে ভাদ্রের প্রকৃতি ঝাপসা হয়ে আসছে। না আমি কাঁদছি না। সিগারেটের ধোঁয়ায়। একটু আগেই বৃষ্টি হচ্ছিল। এখন রোদ ঝলমল করছে। সামনের কাঠগোলাপ গাছটাকে মাত্র স্নান সেরে আসা উনিশ বছর বয়সী তরুণীর মত দেখাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে গেলাম। গতকাল রাতের ঘটনাটা… ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়ার সুযোগ হবে এই ঘটনার জন্য, কাল রাতে ভাবি নি।
দেখছি আমার দু হাত দড়ি দিয়ে বাধা। আমি গামছাটা গলায় পেচিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলছি। কেউ জোড় করেনি। স্বেচ্ছায় ঝুলছি ফ্যানে।
বাপ মা খুব ভালবাসতো আমাকে। প্রচুর কষ্ট করেছেন তারা সারাটা জীবন। আমার জন্য করেন নি এমন কিচ্ছু নেই জীবনে। বাবা প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। স্বপ্ন ছিল ছেলেকে শিক্ষক বানাবেন তাঁরই মত। তাঁরই মত সবাই তাঁর ছেলেকে সম্মান করবে। বাবার সেই স্বপ্নকে সত্যি করতেই আমার কলেজের শিক্ষক হওয়া। কিন্তু আহারে জীবন। বাবা সারাজীবন কষ্ট করেছেন সরকারি প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার হিসেবে, আমি বাকি জীবনটা কষ্ট করে যাব এই সরকারি কলেজের প্রভাষক হিসেবে। এই বেতনে জীবন চলে নাকি আজকাল?
বাবা আমার কাছে কখনও কিচ্ছু চান নি। শুধু এই একটা জিনিসই চেয়েছিলেন, আমি যেন কলেজের শিক্ষক হই। আমি বাবার স্বপ্ন পূরণ করতেই এখানে এসেছি। কিন্তু শহরে থেকে বাবা, মা, আমি আমাদের তিনজনের সংসার বাড়িভাড়া দিয়ে এই সরকারি স্কুলের বেতনে আর চলছে না। আমি ছেলেবেলা থেকেই ব্যবসা করতে চাইতাম। কিন্তু কখনও বাবাকে বলতে পারি নি। ভেবে নিয়েছিলাম একটা কিছু উপায় করবই। কলেজের যে বেতন তা দিয়ে মোটেও তেমন কিছু জমাতে পারি না। ব্যাংক ব্যালেন্স বলতে গেলে নেই ই। আর এতো ক্লাস নিয়েও আর অন্য কাজে মন দেয়া যায় না।
অনেক ভাবনা চিন্তা করে তাই তিন মাস আগে গ্রামের দিকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অল্প একটা জমি লিজ নিয়েছিলাম ৫ বছরের জন্য। সেখানে ঘর তুলেছি একটা। টাকা দিয়ে একটা লোক রেখেছি সেখানে। উদ্দেশ্য খামার করা। এটুকুতেই আমার সব পয়সা শেষ। গ্রামের এক সমিতি থেকে তাই চড়া সুদে ধার করেছি কিছু। ৪টা দুধ দেওয়া গাভী কিনেছি। ভালই চলছিল। গাভীর দুধ বিক্রি করে ধারের টাকা শোধ করছি। কিন্তু জীবনানন্দ মজেছিল বাংলার প্রকৃতিতে, বনলতায় নয়। সেটা তো আমরা হামেশাই ভুলে যাই।
এবারের বর্ষায় এতো বৃষ্টি হল, হুট করে বাধ ভেঙে পুরো গ্রামটা রাতারাতি তলিয়ে যাবে কে ভাবতে পেরেছিল। দিন পনেরো আগে এক রাতে হুট করে গ্রামটার নদীর বাধ ভেঙে যায়। তেমন সমস্যা হত তার পরেও। আমার গোয়ালঘর ডুবে গেলেও গরুগুলো সাঁতরে বাঁচবে ভেবেছিলাম। গরুর গলায় যে দড়ি বাধা ছিল মনেই নেই আমার। অনভিজ্ঞতার দরুন নিচু জমিতে খামার করে মাত্র ৬ ইঞ্চির জন্য গরুগুলো ডুবে মরে এক রাতেই। পেট ভেসে রয়েছে অথচ মাথা পানির নিচে। রাতারাতি পানির নিচে তলিয়ে গেল আমার বিদেশী জাতের গরুগুলো। আমার ১০ লক্ষ্য টাকা।
আমার ১৫ হাজার টাকা বেতনের চাকরিতে আমি পুষিয়ে উঠতে পারব না কখনও এই ঋণ। গত ১৫টা দিন ধরে ঘুমোতে পারি নি। চাকরিটা আছে এখনও। তবুও লাভ কি? কিস্তি দেব কি করে? আমার ছটফটানো আমার মা বুঝে। বুঝে আমি চাপ এ আছি। কিছু জানে না সে তাও কিভাবে যেন সব বুঝে যায়। কাল রাতে ভাত খাওয়ার পর আমি শুয়ে আছি বিছানায় সিলিং ফ্যানের দিকে চেয়ে, চিত হয়ে। মা আমার ঘরে এসেছিলেন। কিছু বলেন নি আমাকে। শুধু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গেলেন কয়েকবার।
মায়ের চোখে কি আমি জল দেখলাম? জানি না। মাথাটা ওলোটপালোট লাগছে। নিজেকে অপ্রকৃতস্থ লাগছে খুব। অনেক দিন পর অভিদা মানে আমার বড়দা কে খুব মিস করছি। বাড়ির অমতে বিয়ে করে উনি আজ ১২ বছর ফ্যামিলির বাইরে। কোথায় আছেন জানি না। যোগাযোগ নেই। বড়দাটা থাকলে ঠিক আমায় উদ্ধার করে নিতো আমায়। বাবাকে বলতে পারব না। মায়ের চোখের জল আর সহ্য হচ্ছে না। কি ভাবতে ভাবতে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালাম আমার ঘরের। বারান্দায় দড়িতে আমার পুরোনো গামছাটা শুকোচ্ছে। রাত ১২.৩০। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। সালার এই বৃষ্টির জন্যই ফাঁস লেগে মরে গেল আমার স্বপ্নগুলো। ছিঁড়ে গেল আমার স্বপ্নগুলো।
ভাবতে ভাবতে চোখ গেল গামছাটায়। লোডশেডীং। ফ্যান অফ। গরম লাগছে। গামছাটার একটা কোনা ছিঁড়ে একটা ফাঁস বানিয়ে নিজের হাত বেঁধে নিলাম। এরপর গামছার বাকি অংশ দিয়ে আরেকটা ফাঁস বানিয়ে সেটা গলায় দিয়েই পাখার সাথে ঝুলে পড়লাম।
হাত বেধেছি কারণ আমার ধারণা ছিল হাত খোলা থাকলে শেষ মুহূর্তে আমি নিজের হাতে ফাঁস খুলে ফেলব। মাথায় সব ফ্ল্যাশব্যাক চলছে। পুরো জীবনের ফ্ল্যাশব্যাক। বাবা, মা, অভিদা, বৌদি, পাড়ার ছোটোভাই রঞ্জন। সব। কালকে ক্লাসের লেকচার রেডি নেই তাও মাথায় এলো। কি লাভ। কাল থেকে আর ক্লাস ই নেওয়া লাগবে না আমার। সব শেষ।
কেমন যেন টান লাগছে গলায়। চড়চড় শব্দ পাচ্ছি, গলার রগ ছিঁড়ে যাচ্ছে নাকি? ভাবতে ভাবতেই দুম করে পুরো পৃথিবীটা আমার উপর এসে আছড়ে পড়ল। আমি পৃথিবীর উপর আছড়ে পড়লাম বলা ভাল। মাজায় ব্যাথা পেয়েছি। অন্ধকারে বুঝছিলাম না কি ঘটেছে। হঠাৎ খুব হাসি পেল।
মা বারবার বলছিল, গামছাটা পুরোনো হয়ে গেছে পালটে নিতে। আমি কিনবো কিনছি বলে আর কিনি নি। সেই পুরোনো গামছাই গলায় দিয়ে সুইসাইড এটেম্পট করেছিলাম। গামছাটা ছিঁড়ে পড়েছি মাটিতে।
উঠে বারান্দায় গিয়ে দাড়িয়েছিলাম। হাত বাইরে বাড়িয়ে দিয়ে হাত ভেজাচ্ছি বৃষ্টিতে। ছোটবেলায় বৃষ্টি হলে মা বাইরে খেলতে যেতে দিত না আমাকে আর অভিদাকে। তখন এভাবে কত দাঁড়িয়ে থেকে হাত ভিজিয়েছি।
অভিদা আমাকে প্রায়ই বলতো, “টিকে থাক ছোট। এই তো আর একটু খানি। এই পৃথিবীতে মানুষের আসার উদ্দেশ্য হচ্ছে যতটুকু সম্ভব বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যা ভাই। দেখবি একটা নতুন দিন ঠিক আসবে। মনে রাখবি, একটা নবজাতক শিশুর ও এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে তার মায়ের দরকার নেই। স্রষ্টা চাইলে সে বেঁচে থাকবেই। তোর চিন্তা করবেন স্রষ্টা। তুই শুধু হাল ছাড়িস না।“
পাশে অভিদাকে মিস করছিলাম খুব।
ঘন্টার শব্দ শুনে বাস্তবে ফিরে এলাম। টিফিনটাইম শেষ। ক্লাস নিতে হবে। ভেবেছিলাম আর লেকচার দেওয়া লাগবে না তাই লেকচার রেডি করি নি। আমার কান্ড দেখিয়া মেঘের আড়ালে বসিয়া হাসেন অন্তর্যামী। আজই আমি আবারও লেকচার ছাড়া ক্লাস নেব।
সিগারেটটা এশট্রেতে পিষতে পিষতে ভাবলাম, আর হাল ছাড়ব না। ঘুড়ে দাঁড়াবোই আমি। বাপ মার রাখা নামের স্বার্থকতা ছাড়া আমি মরব না। এরপর অভিদার ভাষায়, বেঁচে থেকে মরে যাবার স্বার্থক একটা গল্প তৈরি করব।
কাঁথা ছিঁড়ে গেলে আমরা তা ফেলে দিই না। তাতে জোড়াতালি দেই। এরপর তা মুড়ি দিয়ে দেখি আমাদের ছেঁড়াফাটা স্বপ্নগুলি।