A
arunbose
Guest
ঘনাদা
***************************
## Arun Bose ##
বিশিষ্ট সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র ১৯৮৮ সালে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, রেখে গেছেন অজস্র গল্প উপন্যাস কবিতা আর কল্প বিজ্ঞানের ওপরে কিশোর সাহিত্য। ওনার সৃষ্ট চরিত্র ঘনাদা কল্প বিজ্ঞান সাহিত্যের প্রধান চরিত্র ছিলো। ওনার লেখার মধ্যগগনে ঘনাদার গল্প কিশোর সাহিত্যে একটা বিরাট জায়গা করে নিয়েছিল। শ্রদ্ধেও সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্রের তিরধানের পর পাঠকের মন থেকে ঘনাদা ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল।
আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিলো ঘনাদাকে আবার ফিরিয়ে আনার আর আজকের পাঠকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। তাই উদ্যোগী হয়ে আমি নিজেই ঘনাদাকে নিয়ে একটা গল্প লিখেছি। গল্পটার নাম " ঘনাদা ফিরে এলেন "। এই গল্পে প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদার গল্পের সব চরিত্র, সব পটভূমি এবং ভাষা, চেষ্টা করেছি ঘনাদার শ্রষ্টার মতই রাখার। প্রেমেন্দ্র মিত্রের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমার লেখা শুরু করছি।******************************************* *********
********* ঘনাদা ফিরে এলেন ********
৭২ নং বনমালী নস্কর লেনের মেস বাড়িটা এখন যেন ভুতের বাড়ি i সন্ধ্যা হলেই অন্ধকার নেমে আসে , রাত ৯ টার মধ্যেই বোর্ডাররা খেয়ে দেয়ে
দরজায় খিল দিয়ে দেয় i এমনটা কিন্তু আগে ছিল না , সবাই কত হই হুল্লোর গল্প গুজব করতাম, এখনকার অবস্থার অবশ্য একটা কারণ আছে i কারণ এই মেস বাড়ির চিলে কোঠার দরজায় আজ ৩ মাস হলো বিরাট একটা তালা
ঝুলছে i এই ঘরটার যিনি মালিক শ্রীযুক্ত শ্রী ঘনশ্যাম দাস ওরফে ঘনাদা এই একটু আসছি বলে সেই যে বেড়িয়ে গেছেন, আজ প্রায় ৩ মাস হয়ে গেল এখনো ফেরেন নি i কানাঘুষায় শুনেছি বর্ধমানের কোন একটা গ্রামে ঘনাদার এক বৃদ্ধা
পিসিমা থাকতেন, উনি ছাড়া ঘনাদার তিন কুলে আর কেউ নেই i উনি নাকি গত হয়েছেন , তাই ঘনাদা সম্পত্তির একটা বিলি ব্যবস্থা করার জন্য
সেই যে একটু আসছি বলে বেড়িয়ে গেছেন তার পর থেকে আজ ৩ মাস হয়ে গেল ওনার কোনো খবর নেই i
এরই মধ্যে ৭২ নং বনমালী নস্কর লেনের মেস বাড়িতেও অনেক পরিবর্তন হয়েছে i ২ জন পুরানো বোর্ডার অন্যত্র ট্রান্সফার হয়ে গেছে, পুরানোদের মধ্যে আমি আর শিশির শ্বশ্মান জাগিয়ে রয়ে গেছি i নতুন দু জন এসেছে প্রথম জন তাপস ব্যাংক
অফ ইন্ডিয়াতে চাকরি করে , উত্তর বঙ্গ থেকে বদলী হয়ে এই মেস বাড়িতে ঠেক গেড়েছে i আর এক জন পঞ্চানন আমরা পঞ্চু বলে ডাকি ব্যাবসার সুবাদে কলকাতায় , দিল্লির ছেলে i ওরাতো আর ঘনাদাকে দেখে নি , শুধু দেখে
অফিস থেকে ফিরে এসে শিশির ঘর থেকে না খোলা ডানহিল সিগারেটের বড় প্যাকেটটা নিয়ে এসে আমার সাথে হল ঘরটাতে ঘনাদার ইজি চেয়ারটা সামনে বসে থাকতে , আর মাঝে মাঝে চিলে কোঠার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে i
এক দিন কৌতুহল চেপে না রাখতে পেরে আমাদেরই চেপে ধরলো ...ব্যাপারটা কি ? আমরা দুজনে তখন ধীরে ধীরে ঘনাদার পুরো বায়োগ্রাফি
বলেই ফেললাম i ঘনাদার আবিষ্কার অভিযান এডভেঞ্চারের গল্প সব ....কি করে ঘনাদা একটা মশাকে দিয়ে কামড় খাইয়ে পরমানু অস্ত্রের হাত থেকে পৃথিবীকে শেষ হওয়া থেকে রক্ষা করেছিলেন , আফ্রিকার গহন অরন্যে আকাশ ছোয়া পাহাড়ের গুহার ভেতরে বিশাল এনাকোন্ডা সাপের কবল থেকে পৃথিবীর সব থেকে বড় হীরে উদ্ধার করেছিলেন ... এই ইজি চেয়ারে বসে ঘনাদার মুখে শোনা সেই সব এডভেঞ্চারের গল্প i সব শুনে ওদের দুজনের চোখে পুরো অবিশ্বাস
বলেই দিচ্ছে ব্যাপারটা ওরা পুরো হজম করতে পারছে না i পারবে কি করে ? ওরাতো আর ঘনাদার সামনে কোনো দিন বসে নি, ঘনাদার এডভেঞ্চারের কাহিনিও কোনো দিন শোনে নি i আমি আর শিশির দুজনেই ওদের দুজনের জন্য
খুব করুনা বোধ করছিলাম i ......
এই ভাবে গড্ডালিকা প্রবাহের মত দিন আসে দিন যায় i আমি আর শিশির আজকাল প্রায়ই একসাথে মেসে ফিরি i এখন বসন্ত কাল , পাড়ার মোড়ে
বিশাল শিমুল গাছটাতে যেন আগুন লেগেছে লালে লাল হয়ে ফুল ফুটে রয়েছে i কিন্তু আমাদের মনের আগুন নিভে গিয়ে যেন এক গাদা ছাই পড়ে রয়েছে i এমনি একদিন আমি আর শিশির অফিস ফেরত একটা সান্ধ্য আজকাল পত্রিকা
কিনে মেসে ফিরছি i শিমুল গাছটার কাছে এলে আমাদের মেসটা দেখা যায় i একি দেখছি? আকাশটা কি নেমে এলো হাতের মুঠোয় ? নাকি শিমুল ফুলের
লাল রঙের আগুনের ঝিলিক আমাদের চোখে বিভ্রম সৃষ্টি করছে ? দুজনেই বার বার চোখ কচলাতে থাকিi না ঠিকই দেখছি i ৭ নং বনমালী লেনের মেস
বাড়িটার চিলে কোঠা থেকে ইলেকট্রিক আলো ছিটকে বেরোচ্ছে, যেন মহাকাশ জুড়ে ছুটে চলা ধুমকেতুর লেজে বাঁধা অসংখ্য আলোর বিচ্ছুরণ i
তার মানে আমি আর শিশির দুজনে দুজনার দিকে তাকিয়ে একসাথে বলে ফেললাম ...ঘনাদা এসে গেছে i উত্তেজনায় আমাদের বুক চির চির করছে, আমাদের চলার গতি যেন এক ধাক্কায় ডবল হয়ে গেলো, অবশেষে আমরা মেসে পৌছালাম i দেখি ঠাকুর এক কাপ চা নিয়ে চিলে কোঠার দিকে যাচ্ছে ,
আমাদের দেখে এক গাল হেসে বলল , ......
বড়বাবু এসে গেছেন i
এবার আপনাদের আজকের ঘনাদার সম্বন্ধে একটু জানিয়ে রাখি .... ঘনাদা আজকাল ডেনিম জিনস আর ব্র্যান্ডেড টি সার্ট ছাড়া কিছু পরতে পছন্দ করেন না , অবশ্য ঘরে সাদা পাঞ্জাবী আর পাজামা বা সিল্কের লুঙ্গি ওনার পছন্দ i
হাতে সব সময় লেটেস্ট মডেলের হাই পিক্সেল ক্যামেরা স্মার্ট মোবাইল ফোন ...সব সময় কারুর না কারুর সাথে কথা বলছেন, আর ঘরে যতক্ষণ থাকেন ল্যাপটপ কম্পুটারে কি যে করেন আমরা জানতে পারি না i মাসে একবার চুলে ওয়েলা কালার না করতে পারলে ওনার মেজাজ তিরিক্ষে হয়ে ওঠে i এহেন ঘনাদা ৩ মাস পরে মেসে ফিরে সেই যে চিলে কোঠায় ঢুকে দরজায় খিল দিয়েছেন আজ ৪ দিন হয়ে গেলো একবারের জন্যও নিচে নামেন নি i সকাল দুপুর রাতে সব খাবারই ঠাকুর ওপরে দিয়ে আসছে i আমার আর শিশিরের খুবই খারাপ অবস্থা , তাপস আর পঞ্চুর কাছে প্রেস্টিজ রাখাই দায় হয়ে পরেছে i চেপে ধরলাম ঠাকুরকে বন্ধ চিলে কোঠায় ঘনাদা এই ৪ দিন কি করছে ...
ঠাকুরেরই একমাত্র ছাড়পত্র আছে ওই ঘরে ঢোকার i ঠাকুর যা বলল তা শুনেতো আমাদের চক্ষু চরক গাছ i ঘনাদা নাকি তুলোর মধ্যে রাখা একটা চক
চকে সাদা ট্রান্সপারেন্ট স্ফটিকের মত চৌকো বস্তু আতস কাচ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন আবার ল্যাপটপ ঘাটা ঘাটি করে ডায়রিতে কি সব নোট
করছেন i আমরা ঠাকুরের কাছে এই সব শুনে মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না i
আজ রবিবার, কারুর অফিস কাছারী নেই i রবিবার দিন সাধারনত অন্যান্য দিনের থেকে একটু অন্যরকম ভাবে কাটে মেসের বোর্ডারদের I সকালের মেনুতে লুচি আলুভাজা বেগুন ভাজা আর মিষ্টি i আর দুপুরে অবশ্যই মাংস i আজ হয়েছে ঘনাদার অতি প্রিয় কচি পাঠার ঝোল i দেখলাম ঠাকুর একটা প্লেটে গোটা আটেক লুচি আলুভাজা বেগুনভাজা আর খানকয়েক সন্দেশ নিয়ে সিড়ি ভেঙ্গে উঠে চিলে কোঠায় ঢুকে গেলো i খানিকক্ষণ বাদে নেমে এলো এক গাল হাসি নিয়ে , আমরাতো ঠাকুরকে চেপে ধরেছি ...কি ব্যাপার ?
ঠাকুর যা বললো শুনেতো আমাদের মধ্যে বিদ্যুত তরঙ্গের মতো উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো , বললো বড়বাবু দুপুরের খাবারের মেনু শুনে বললেন আজ
সকলের সাথে খাবারের ঘরেই খাবেন i আমরা কি করব বুঝে উঠতে পারছি না , শিশির ছুটে চলে গেলো আর এক প্যাকেট ডানহিল সিগারেট কেনার জন্য যদি ঘনাদা পুরনো প্যাকেটটাতে হাত না দেন i আমি ঠাকুরকে বললাম মাংস রান্না হয়ে গেলে আমাকে দেখিয়ে বড় একটা বাটিতে আগেই ঘনাদার জন্য
বড় বড় পিস গুলো উঠিয়ে রাখতে i কত দিন পরে এই ৭ নং বনমালী লেনের এই মেস বাড়িটা উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে i
যথা সময়ে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে পরলো, আমরা খাবার ঘরের যে যার চেয়ারে বসা, ঘনাদার চেয়ারটা মাঝামাঝি জায়গায় i যখন ঘনাদা মেসে থাকেন না
আমরা কেউ কখনো ওই নিদৃষ্ট চেয়ারটায় বসি না i পঞ্চু একবার চেষ্টা করেছিল আমাদের ধমক খেয়ে আর ওপথ মাড়ায়নি i শুধু বিস্মিত দৃষ্টিতে মাঝে
মাঝে ওই চেয়ারটার দিকে তাকাতো i মেস বাড়িতে বহু দিন আগে থেকেই চালু
ছিলো , ঘনাদাকে আগে খাবার দেয়া হবে তারপর আমাদের i সেই রীতিতে যথারীতি আমরা সবাই বসে আছি কখন ঘনাদা আসবেন i হটাৎ সিড়িতে চটির আওয়াজ , আমরা দেখলাম ঘনাদা পাঞ্জাবীর বদলে একটা ফতুয়া আর বার্মিজদের মতো একটা সিল্কের লুঙ্গি পরে খাবার ঘরে ঢুকলেন , চেয়ারে বসে
স্মিত মুখে আমাদের সকলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ...তোমরা সবাই ভালো আছতো ? আমি আর শিশির তারাতারি করে নতুন বোর্ডার পঞ্চু আর তাপসকে ঘনাদার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। যথারীতি ঠাকুর ভাতের প্লেট মাংসের বাটি আর যাযা আছে সব ঘনাদার সামনে রেখে দিয়ে আমাদের খেতে দিতে শুরু করলো i সকলের খাওয়া শেষ হতে আমরা তারাতারি করে
হাত মুখ ধুয়ে বাইরের ঘরে যেখানে ঘনাদার ইজি চেয়ারটা আছে সেই ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে গল্প করা শুরু করলাম, যেন কিছুই না রোজ যেমন
করি i কিন্তু আমার আর শিশিরের বুকের ভেতরটা তোলপার করছে , ঘনাদা এই ঘরে আসবেন তো? কানে কানে শিশিরকে সিগেরেটের কথা জিগ্যেস করতে ও বলল সব ঠিক আছে i ঘড়ির কাটা টিক টিক করে চলছে , শুনতে পাচ্ছি ঘনাদা মুখ ধুচ্ছে , তারপরে আবার চুপচাপ, ঠাকুরের গলার আওয়াজ ...এই নিন বড়বাবু তোয়ালে i এইবার ঘনাদার চটির আওয়াজ , ওপরে উঠে যাবেন নাত ? হটাৎ আমাদের চমকে দিয়ে এই ঘরেই ঘনাদা ঢুকলেন , এবং ওনার নির্দিষ্ট ইজি চেয়ারে বসে আনমনে শিশিরের দিকে বা হাত টা বাড়িয়ে দিতেই ডানহিল সিগারেটের প্যাকেট টা থেকে একটা সিগারেট শিশির ওনার দু আঙ্গুলের ফাকে গুঁজে দিল, আর দেশলাই টা ঘনাদার হাতে ধরিয়ে দিল i ঘনাদা সিগারেট টা ধরিয়ে একটা সুখটান দিয়ে আমাদের সবার মুখের দিকে তাকিয়ে
মুচকি মুচকি হেসে বললেন , তাহলে তোমরা সবাই ভালই আছ i আমাদের অবস্থা তখন অগ্নুৎপাত না হওয়া আগ্নেয়গিরির মতো, উত্তেজনায় হাত পা কাঁপছে, বুক দূর দূর করছে তবেকি অনেক দিন বাদে ঘনাদা আবার তার ৩ মাস অনুপস্থিত থাকার কারণ বলবে, আবার আমরা শুনতে পাবো ঘনাদার কোন অবিশ্বাস্য আবিষ্কার বা মঙ্গল গ্রহে যাত্রার কোন লোমহর্ষক কাহিনী ?
হটাৎ ঘনাদা সকলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা তুতেনখামনের নাম শুনেছ ? সবাই সবার দিকে মুখ চাওয়াচায়ি করছে দেখে আমি বলেই
ফেললাম ..হ্যা, ইজিপ্টের ফারাও মানে রাজা যার মৃত্যুর পর বিশাল পিরামিড বানিয়ে রাজকীয় ভাবে সমাধিস্থ করা হয়েছিল i পৃথিবীর ইতিহাসে লেখা বিখ্যাত তুতেনখামনের টুম্ব i আমার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন তুতেনের বাবা আর মায়ের নাম জানো ? আমি থতমত খেয়ে চুপ করে যেতেই ঘনাদা শুরু করে দিল , তখন ইজিপ্টের ফারাও তুতেনখামনের বাবা আখেনাটেন। তুতেনখামনের পরিবার ইনসেস্ট ছিল
মানে পরিবারের মধ্যে বিয়ে সাদী চলতো, তুতেনের বাবা নিজের আপন বোনকে বিয়ে করেছিল , তার গর্ভেই তুতেনের জন্ম i মায়ের নাম আনখেনসেন i বাস্তবে তুতেনখামের পিসি ছিলেন i বাবার মৃত্যুর পর অল্প বয়েসে তুতেন সিংহাসনে বসে ফারাও হন i নিজে বাবার তৃতীয় কন্যা মানে তুতেন তার তৃতীয় বোনকে বিয়ে করে , তাদের সন্তানাদিও হয় i অল্প বয়েস থেকে তুতেনের খুব বিজ্ঞানের দিকে ঝোক ছিল , নানা রকমের পাথর কাচ লোহা সোনা জাতীয় জিনিস নিয়ে খুটখাট করতো i একদিন একটা বাক্সের মত জিনিস বানিয়ে তার মধ্যে একটা চৌকো স্ফটিকের মত স্বচ্ছ পাথর বসিয়ে দিতেই স্ফটিকটা ইলেকট্রিক বাল্বের মত উজ্জ্বল হয়ে নড়াচড়া শুরু করলো i তুতেন অবাক হয়ে দেখে অর চার দিকের সব দৃশ্য গুলো এমনকি তার পরিবারের সব চলা ফেরা , প্রাসাদের সব ছবি স্ফটিকটার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে i বুঝতে পারল ও এমন একটা কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছে যার মধ্যে ওর যুগের সব কিছু আজকের ভাষায় রেকোর্ডেড হয়ে যাচ্ছে i বাক্সটা থেকে স্ফটিকটা বার করলেই আবার যে কে সেই , নেই কোনো আলোর আভাস i তুতেন স্ফটিকটা উল্টো করে বাক্সটার মধ্যে ঢুকাতেই ওটার থেকে একটা আলোর রশ্মি ঘরের দেয়ালে প্রতিফলিত হয়ে ওটার মধ্যে ঢুকে যাওয়া দৃশ্য গুলি একের পর এক চোখের সামনে এসে যাচ্ছে i
আমরাতো ঘনাদার কথা গুলো গিলছিলাম আমাদের অবস্থা দেখে একটু চুপ করে থেকে বললেন আসলে বুঝলে না ওই স্ফটিকটা একটা হার্ড ডিস্কের কাজ করছিলো i তারপর আবার শুরু করে বললেন তুতেনখামন বেশি দিন বাঁচেনি , মাত্র ১৯ বছর বয়েসে মারা যান i ইজিপ্টের নিয়ম অনুযায়ী তুতেনখামনের দেহ মমি করে সোনার মুখোশ পরিয়ে রাজকীয় ভাবে ইজিপ্টের কিংস ভ্যালিতে সমাধিস্থ করে ওপরে পিরামিডের টুম্ব বানিয়ে দেয়া হয়েছিল i
পরবর্তী কালে ইজিপ্ট প্রশাসন ওই টুম্বটার নাম্বারিং করেছিল KV62 I আবার খানিকক্ষণ ঘনাদা চুপ করে থাকতেই শিশির একটার পর একটা সিগারেট ধরিয়ে ওনার আঙ্গুলের মাঝে গুঁজে দিচ্ছিল i
ঘনাদা বললেন , এবার শোনো তুতেনখামনের গল্পটা তোমাদের শোনালাম কেন i তোমরা জানতে আমি পিসির মৃত্যু সংবাদ পেয়ে বর্ধমান গেছি ওনার সব সম্পত্তির বিলি ব্যবস্থা করতে i সব হয়ে যাওয়ার পর আমি পিসির ঠাকুরের আসনে সেই চৌকো স্ফটিকটা পাই চন্দন সিন্দুর মাখানো অবস্থায় , আসলে পিসি ওটাকে ঠাকুর ভেবে শালগ্রাম শিলার মত পুঁজো করত i শুনেছিলাম পিসির এক দূর সম্পর্কের ভাশুর নাকি এক সময় ইজিপ্টের কোন এক পিরামিডের কিউরেটর ছিলেন , ওনারও পিসি ছাড়া আগে পিছে কেউ ছিল না i তাই মারা যাওয়ার আগে অসুস্থ অবস্থায় কিছু দিন বর্ধমানে পিসির কাছে ছিলেন i বর্ধমানেই উনি মারা যান i মারা যাওয়ার আগে উনি একটা চৌকো স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো বস্তু পিসিকে দিয়ে যান , আর বলে যান এটা একটা পৃথিবীর ইতিহাস যত্ন করে রেখে দিও i সেই থেকে পিসি ওই বস্তুটিকে
ঠাকুর জ্ঞানে ঠাকুরের আসনে রেখে সিন্দুর চন্দন ফুল বেলপাতা দিয়ে পুঁজো করতেন i আমার কি রকম সন্দেহ হলো , আমি তখন স্ফটিকটাকে ভালো করে
ধুয়ে পরিষ্কার করে একটা আতস কাচ দিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখলাম পুরো চৌকো স্ফটিকটার গায় কত রকমের ছবি আকা , কোনটা ঘোড়ার মাথা
ওয়ালা মানুষ লুঙ্গির মত কাপড় পরা , কত রকমের জীব জন্তু , বড় বড় লম্বা লম্বা হারির মতো বস্তু , বুঝলাম এই ছবিগুলোই ইজিপ্সিয়ান হরফ , বস্তুটাতে
নিশ্চয়ই অনেক কিছু লেখা আছে i আমি কাউকে কিছু না বলে স্ফটিকটা নিয়ে সোজা দিল্লি চলে গেলাম , ওখানকার ফরেন মিনিস্ট্রিতে মিশরীয় ডেস্কের ভার
প্রাপ্ত আধিকারিকের সাহায্যে একজন ইজিপ্সিয়ান ভাষা বিদকে দিয়ে পুরো ব্যাপারটা বুঝে নোট করে নিলাম i সেই গল্পটাই আজ তোমাদের বললাম i
আমি এখন খুব ব্যাস্ত , কি করে কম্পুটারের external হার্ড ডিস্কের সাথে এই স্ফটিকটার সংযোগ ঘটিয়ে এটার মধ্যে থাকা পুরো ভিডিও টাকে কম্পুটারে
ট্রান্সফার করাতে পারি, সেটা নিয়েই মাথা ঘামাচ্ছি i স্ফটিকটার মধ্যে থাকা ফাইলটা ওপেন করতে পারলে পৃথিবীর ইতিহাসে একটা আলোড়ন পড়ে যাবে i
তাই তোমরা আমাকে খুব বেশি একটা বিরক্ত করো না i এই বলে ঘনাদা উঠে দাড়ালেন, আর যেন আনমনে শিশিরের রাখা পুরো ডানহিল সিগেরেটের
প্যাকেট টা নিয়ে চটির ফট ফট আওয়াজ করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে চিলে কোঠায় উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন i আর এদিকে বসার ঘরে তখন
পিন পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছিলো আমাদের সকলের এমনি অবস্থা i পঞ্চু আর তাপস এই প্রথম ঘনাদার বাণী শুনলো , ওরা কেমন হতভম্ভের মত ফ্যাল ফ্যাল করে ইজি চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে আছে i
সকলে হটাৎ চমকে গেলাম ঠাকুরের গলার আওয়াজে .... চা হয়ে গেছে, তোমরা সকলে চা খেতে এসো, আমি বড় বাবুর চা টা ওপরে দিয়ে আসছি i
কখন যে বিকেল হয়ে গেছে আমরা কেউ বুঝতেও পারিনি i ...........
********** সমাপ্ত ************
***************************
## Arun Bose ##
বিশিষ্ট সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র ১৯৮৮ সালে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, রেখে গেছেন অজস্র গল্প উপন্যাস কবিতা আর কল্প বিজ্ঞানের ওপরে কিশোর সাহিত্য। ওনার সৃষ্ট চরিত্র ঘনাদা কল্প বিজ্ঞান সাহিত্যের প্রধান চরিত্র ছিলো। ওনার লেখার মধ্যগগনে ঘনাদার গল্প কিশোর সাহিত্যে একটা বিরাট জায়গা করে নিয়েছিল। শ্রদ্ধেও সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্রের তিরধানের পর পাঠকের মন থেকে ঘনাদা ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল।
আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিলো ঘনাদাকে আবার ফিরিয়ে আনার আর আজকের পাঠকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। তাই উদ্যোগী হয়ে আমি নিজেই ঘনাদাকে নিয়ে একটা গল্প লিখেছি। গল্পটার নাম " ঘনাদা ফিরে এলেন "। এই গল্পে প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদার গল্পের সব চরিত্র, সব পটভূমি এবং ভাষা, চেষ্টা করেছি ঘনাদার শ্রষ্টার মতই রাখার। প্রেমেন্দ্র মিত্রের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমার লেখা শুরু করছি।******************************************* *********
********* ঘনাদা ফিরে এলেন ********
৭২ নং বনমালী নস্কর লেনের মেস বাড়িটা এখন যেন ভুতের বাড়ি i সন্ধ্যা হলেই অন্ধকার নেমে আসে , রাত ৯ টার মধ্যেই বোর্ডাররা খেয়ে দেয়ে
দরজায় খিল দিয়ে দেয় i এমনটা কিন্তু আগে ছিল না , সবাই কত হই হুল্লোর গল্প গুজব করতাম, এখনকার অবস্থার অবশ্য একটা কারণ আছে i কারণ এই মেস বাড়ির চিলে কোঠার দরজায় আজ ৩ মাস হলো বিরাট একটা তালা
ঝুলছে i এই ঘরটার যিনি মালিক শ্রীযুক্ত শ্রী ঘনশ্যাম দাস ওরফে ঘনাদা এই একটু আসছি বলে সেই যে বেড়িয়ে গেছেন, আজ প্রায় ৩ মাস হয়ে গেল এখনো ফেরেন নি i কানাঘুষায় শুনেছি বর্ধমানের কোন একটা গ্রামে ঘনাদার এক বৃদ্ধা
পিসিমা থাকতেন, উনি ছাড়া ঘনাদার তিন কুলে আর কেউ নেই i উনি নাকি গত হয়েছেন , তাই ঘনাদা সম্পত্তির একটা বিলি ব্যবস্থা করার জন্য
সেই যে একটু আসছি বলে বেড়িয়ে গেছেন তার পর থেকে আজ ৩ মাস হয়ে গেল ওনার কোনো খবর নেই i
এরই মধ্যে ৭২ নং বনমালী নস্কর লেনের মেস বাড়িতেও অনেক পরিবর্তন হয়েছে i ২ জন পুরানো বোর্ডার অন্যত্র ট্রান্সফার হয়ে গেছে, পুরানোদের মধ্যে আমি আর শিশির শ্বশ্মান জাগিয়ে রয়ে গেছি i নতুন দু জন এসেছে প্রথম জন তাপস ব্যাংক
অফ ইন্ডিয়াতে চাকরি করে , উত্তর বঙ্গ থেকে বদলী হয়ে এই মেস বাড়িতে ঠেক গেড়েছে i আর এক জন পঞ্চানন আমরা পঞ্চু বলে ডাকি ব্যাবসার সুবাদে কলকাতায় , দিল্লির ছেলে i ওরাতো আর ঘনাদাকে দেখে নি , শুধু দেখে
অফিস থেকে ফিরে এসে শিশির ঘর থেকে না খোলা ডানহিল সিগারেটের বড় প্যাকেটটা নিয়ে এসে আমার সাথে হল ঘরটাতে ঘনাদার ইজি চেয়ারটা সামনে বসে থাকতে , আর মাঝে মাঝে চিলে কোঠার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে i
এক দিন কৌতুহল চেপে না রাখতে পেরে আমাদেরই চেপে ধরলো ...ব্যাপারটা কি ? আমরা দুজনে তখন ধীরে ধীরে ঘনাদার পুরো বায়োগ্রাফি
বলেই ফেললাম i ঘনাদার আবিষ্কার অভিযান এডভেঞ্চারের গল্প সব ....কি করে ঘনাদা একটা মশাকে দিয়ে কামড় খাইয়ে পরমানু অস্ত্রের হাত থেকে পৃথিবীকে শেষ হওয়া থেকে রক্ষা করেছিলেন , আফ্রিকার গহন অরন্যে আকাশ ছোয়া পাহাড়ের গুহার ভেতরে বিশাল এনাকোন্ডা সাপের কবল থেকে পৃথিবীর সব থেকে বড় হীরে উদ্ধার করেছিলেন ... এই ইজি চেয়ারে বসে ঘনাদার মুখে শোনা সেই সব এডভেঞ্চারের গল্প i সব শুনে ওদের দুজনের চোখে পুরো অবিশ্বাস
বলেই দিচ্ছে ব্যাপারটা ওরা পুরো হজম করতে পারছে না i পারবে কি করে ? ওরাতো আর ঘনাদার সামনে কোনো দিন বসে নি, ঘনাদার এডভেঞ্চারের কাহিনিও কোনো দিন শোনে নি i আমি আর শিশির দুজনেই ওদের দুজনের জন্য
খুব করুনা বোধ করছিলাম i ......
এই ভাবে গড্ডালিকা প্রবাহের মত দিন আসে দিন যায় i আমি আর শিশির আজকাল প্রায়ই একসাথে মেসে ফিরি i এখন বসন্ত কাল , পাড়ার মোড়ে
বিশাল শিমুল গাছটাতে যেন আগুন লেগেছে লালে লাল হয়ে ফুল ফুটে রয়েছে i কিন্তু আমাদের মনের আগুন নিভে গিয়ে যেন এক গাদা ছাই পড়ে রয়েছে i এমনি একদিন আমি আর শিশির অফিস ফেরত একটা সান্ধ্য আজকাল পত্রিকা
কিনে মেসে ফিরছি i শিমুল গাছটার কাছে এলে আমাদের মেসটা দেখা যায় i একি দেখছি? আকাশটা কি নেমে এলো হাতের মুঠোয় ? নাকি শিমুল ফুলের
লাল রঙের আগুনের ঝিলিক আমাদের চোখে বিভ্রম সৃষ্টি করছে ? দুজনেই বার বার চোখ কচলাতে থাকিi না ঠিকই দেখছি i ৭ নং বনমালী লেনের মেস
বাড়িটার চিলে কোঠা থেকে ইলেকট্রিক আলো ছিটকে বেরোচ্ছে, যেন মহাকাশ জুড়ে ছুটে চলা ধুমকেতুর লেজে বাঁধা অসংখ্য আলোর বিচ্ছুরণ i
তার মানে আমি আর শিশির দুজনে দুজনার দিকে তাকিয়ে একসাথে বলে ফেললাম ...ঘনাদা এসে গেছে i উত্তেজনায় আমাদের বুক চির চির করছে, আমাদের চলার গতি যেন এক ধাক্কায় ডবল হয়ে গেলো, অবশেষে আমরা মেসে পৌছালাম i দেখি ঠাকুর এক কাপ চা নিয়ে চিলে কোঠার দিকে যাচ্ছে ,
আমাদের দেখে এক গাল হেসে বলল , ......
বড়বাবু এসে গেছেন i
এবার আপনাদের আজকের ঘনাদার সম্বন্ধে একটু জানিয়ে রাখি .... ঘনাদা আজকাল ডেনিম জিনস আর ব্র্যান্ডেড টি সার্ট ছাড়া কিছু পরতে পছন্দ করেন না , অবশ্য ঘরে সাদা পাঞ্জাবী আর পাজামা বা সিল্কের লুঙ্গি ওনার পছন্দ i
হাতে সব সময় লেটেস্ট মডেলের হাই পিক্সেল ক্যামেরা স্মার্ট মোবাইল ফোন ...সব সময় কারুর না কারুর সাথে কথা বলছেন, আর ঘরে যতক্ষণ থাকেন ল্যাপটপ কম্পুটারে কি যে করেন আমরা জানতে পারি না i মাসে একবার চুলে ওয়েলা কালার না করতে পারলে ওনার মেজাজ তিরিক্ষে হয়ে ওঠে i এহেন ঘনাদা ৩ মাস পরে মেসে ফিরে সেই যে চিলে কোঠায় ঢুকে দরজায় খিল দিয়েছেন আজ ৪ দিন হয়ে গেলো একবারের জন্যও নিচে নামেন নি i সকাল দুপুর রাতে সব খাবারই ঠাকুর ওপরে দিয়ে আসছে i আমার আর শিশিরের খুবই খারাপ অবস্থা , তাপস আর পঞ্চুর কাছে প্রেস্টিজ রাখাই দায় হয়ে পরেছে i চেপে ধরলাম ঠাকুরকে বন্ধ চিলে কোঠায় ঘনাদা এই ৪ দিন কি করছে ...
ঠাকুরেরই একমাত্র ছাড়পত্র আছে ওই ঘরে ঢোকার i ঠাকুর যা বলল তা শুনেতো আমাদের চক্ষু চরক গাছ i ঘনাদা নাকি তুলোর মধ্যে রাখা একটা চক
চকে সাদা ট্রান্সপারেন্ট স্ফটিকের মত চৌকো বস্তু আতস কাচ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন আবার ল্যাপটপ ঘাটা ঘাটি করে ডায়রিতে কি সব নোট
করছেন i আমরা ঠাকুরের কাছে এই সব শুনে মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না i
আজ রবিবার, কারুর অফিস কাছারী নেই i রবিবার দিন সাধারনত অন্যান্য দিনের থেকে একটু অন্যরকম ভাবে কাটে মেসের বোর্ডারদের I সকালের মেনুতে লুচি আলুভাজা বেগুন ভাজা আর মিষ্টি i আর দুপুরে অবশ্যই মাংস i আজ হয়েছে ঘনাদার অতি প্রিয় কচি পাঠার ঝোল i দেখলাম ঠাকুর একটা প্লেটে গোটা আটেক লুচি আলুভাজা বেগুনভাজা আর খানকয়েক সন্দেশ নিয়ে সিড়ি ভেঙ্গে উঠে চিলে কোঠায় ঢুকে গেলো i খানিকক্ষণ বাদে নেমে এলো এক গাল হাসি নিয়ে , আমরাতো ঠাকুরকে চেপে ধরেছি ...কি ব্যাপার ?
ঠাকুর যা বললো শুনেতো আমাদের মধ্যে বিদ্যুত তরঙ্গের মতো উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো , বললো বড়বাবু দুপুরের খাবারের মেনু শুনে বললেন আজ
সকলের সাথে খাবারের ঘরেই খাবেন i আমরা কি করব বুঝে উঠতে পারছি না , শিশির ছুটে চলে গেলো আর এক প্যাকেট ডানহিল সিগারেট কেনার জন্য যদি ঘনাদা পুরনো প্যাকেটটাতে হাত না দেন i আমি ঠাকুরকে বললাম মাংস রান্না হয়ে গেলে আমাকে দেখিয়ে বড় একটা বাটিতে আগেই ঘনাদার জন্য
বড় বড় পিস গুলো উঠিয়ে রাখতে i কত দিন পরে এই ৭ নং বনমালী লেনের এই মেস বাড়িটা উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে i
যথা সময়ে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে পরলো, আমরা খাবার ঘরের যে যার চেয়ারে বসা, ঘনাদার চেয়ারটা মাঝামাঝি জায়গায় i যখন ঘনাদা মেসে থাকেন না
আমরা কেউ কখনো ওই নিদৃষ্ট চেয়ারটায় বসি না i পঞ্চু একবার চেষ্টা করেছিল আমাদের ধমক খেয়ে আর ওপথ মাড়ায়নি i শুধু বিস্মিত দৃষ্টিতে মাঝে
মাঝে ওই চেয়ারটার দিকে তাকাতো i মেস বাড়িতে বহু দিন আগে থেকেই চালু
ছিলো , ঘনাদাকে আগে খাবার দেয়া হবে তারপর আমাদের i সেই রীতিতে যথারীতি আমরা সবাই বসে আছি কখন ঘনাদা আসবেন i হটাৎ সিড়িতে চটির আওয়াজ , আমরা দেখলাম ঘনাদা পাঞ্জাবীর বদলে একটা ফতুয়া আর বার্মিজদের মতো একটা সিল্কের লুঙ্গি পরে খাবার ঘরে ঢুকলেন , চেয়ারে বসে
স্মিত মুখে আমাদের সকলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ...তোমরা সবাই ভালো আছতো ? আমি আর শিশির তারাতারি করে নতুন বোর্ডার পঞ্চু আর তাপসকে ঘনাদার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। যথারীতি ঠাকুর ভাতের প্লেট মাংসের বাটি আর যাযা আছে সব ঘনাদার সামনে রেখে দিয়ে আমাদের খেতে দিতে শুরু করলো i সকলের খাওয়া শেষ হতে আমরা তারাতারি করে
হাত মুখ ধুয়ে বাইরের ঘরে যেখানে ঘনাদার ইজি চেয়ারটা আছে সেই ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে গল্প করা শুরু করলাম, যেন কিছুই না রোজ যেমন
করি i কিন্তু আমার আর শিশিরের বুকের ভেতরটা তোলপার করছে , ঘনাদা এই ঘরে আসবেন তো? কানে কানে শিশিরকে সিগেরেটের কথা জিগ্যেস করতে ও বলল সব ঠিক আছে i ঘড়ির কাটা টিক টিক করে চলছে , শুনতে পাচ্ছি ঘনাদা মুখ ধুচ্ছে , তারপরে আবার চুপচাপ, ঠাকুরের গলার আওয়াজ ...এই নিন বড়বাবু তোয়ালে i এইবার ঘনাদার চটির আওয়াজ , ওপরে উঠে যাবেন নাত ? হটাৎ আমাদের চমকে দিয়ে এই ঘরেই ঘনাদা ঢুকলেন , এবং ওনার নির্দিষ্ট ইজি চেয়ারে বসে আনমনে শিশিরের দিকে বা হাত টা বাড়িয়ে দিতেই ডানহিল সিগারেটের প্যাকেট টা থেকে একটা সিগারেট শিশির ওনার দু আঙ্গুলের ফাকে গুঁজে দিল, আর দেশলাই টা ঘনাদার হাতে ধরিয়ে দিল i ঘনাদা সিগারেট টা ধরিয়ে একটা সুখটান দিয়ে আমাদের সবার মুখের দিকে তাকিয়ে
মুচকি মুচকি হেসে বললেন , তাহলে তোমরা সবাই ভালই আছ i আমাদের অবস্থা তখন অগ্নুৎপাত না হওয়া আগ্নেয়গিরির মতো, উত্তেজনায় হাত পা কাঁপছে, বুক দূর দূর করছে তবেকি অনেক দিন বাদে ঘনাদা আবার তার ৩ মাস অনুপস্থিত থাকার কারণ বলবে, আবার আমরা শুনতে পাবো ঘনাদার কোন অবিশ্বাস্য আবিষ্কার বা মঙ্গল গ্রহে যাত্রার কোন লোমহর্ষক কাহিনী ?
হটাৎ ঘনাদা সকলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা তুতেনখামনের নাম শুনেছ ? সবাই সবার দিকে মুখ চাওয়াচায়ি করছে দেখে আমি বলেই
ফেললাম ..হ্যা, ইজিপ্টের ফারাও মানে রাজা যার মৃত্যুর পর বিশাল পিরামিড বানিয়ে রাজকীয় ভাবে সমাধিস্থ করা হয়েছিল i পৃথিবীর ইতিহাসে লেখা বিখ্যাত তুতেনখামনের টুম্ব i আমার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন তুতেনের বাবা আর মায়ের নাম জানো ? আমি থতমত খেয়ে চুপ করে যেতেই ঘনাদা শুরু করে দিল , তখন ইজিপ্টের ফারাও তুতেনখামনের বাবা আখেনাটেন। তুতেনখামনের পরিবার ইনসেস্ট ছিল
মানে পরিবারের মধ্যে বিয়ে সাদী চলতো, তুতেনের বাবা নিজের আপন বোনকে বিয়ে করেছিল , তার গর্ভেই তুতেনের জন্ম i মায়ের নাম আনখেনসেন i বাস্তবে তুতেনখামের পিসি ছিলেন i বাবার মৃত্যুর পর অল্প বয়েসে তুতেন সিংহাসনে বসে ফারাও হন i নিজে বাবার তৃতীয় কন্যা মানে তুতেন তার তৃতীয় বোনকে বিয়ে করে , তাদের সন্তানাদিও হয় i অল্প বয়েস থেকে তুতেনের খুব বিজ্ঞানের দিকে ঝোক ছিল , নানা রকমের পাথর কাচ লোহা সোনা জাতীয় জিনিস নিয়ে খুটখাট করতো i একদিন একটা বাক্সের মত জিনিস বানিয়ে তার মধ্যে একটা চৌকো স্ফটিকের মত স্বচ্ছ পাথর বসিয়ে দিতেই স্ফটিকটা ইলেকট্রিক বাল্বের মত উজ্জ্বল হয়ে নড়াচড়া শুরু করলো i তুতেন অবাক হয়ে দেখে অর চার দিকের সব দৃশ্য গুলো এমনকি তার পরিবারের সব চলা ফেরা , প্রাসাদের সব ছবি স্ফটিকটার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে i বুঝতে পারল ও এমন একটা কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছে যার মধ্যে ওর যুগের সব কিছু আজকের ভাষায় রেকোর্ডেড হয়ে যাচ্ছে i বাক্সটা থেকে স্ফটিকটা বার করলেই আবার যে কে সেই , নেই কোনো আলোর আভাস i তুতেন স্ফটিকটা উল্টো করে বাক্সটার মধ্যে ঢুকাতেই ওটার থেকে একটা আলোর রশ্মি ঘরের দেয়ালে প্রতিফলিত হয়ে ওটার মধ্যে ঢুকে যাওয়া দৃশ্য গুলি একের পর এক চোখের সামনে এসে যাচ্ছে i
আমরাতো ঘনাদার কথা গুলো গিলছিলাম আমাদের অবস্থা দেখে একটু চুপ করে থেকে বললেন আসলে বুঝলে না ওই স্ফটিকটা একটা হার্ড ডিস্কের কাজ করছিলো i তারপর আবার শুরু করে বললেন তুতেনখামন বেশি দিন বাঁচেনি , মাত্র ১৯ বছর বয়েসে মারা যান i ইজিপ্টের নিয়ম অনুযায়ী তুতেনখামনের দেহ মমি করে সোনার মুখোশ পরিয়ে রাজকীয় ভাবে ইজিপ্টের কিংস ভ্যালিতে সমাধিস্থ করে ওপরে পিরামিডের টুম্ব বানিয়ে দেয়া হয়েছিল i
পরবর্তী কালে ইজিপ্ট প্রশাসন ওই টুম্বটার নাম্বারিং করেছিল KV62 I আবার খানিকক্ষণ ঘনাদা চুপ করে থাকতেই শিশির একটার পর একটা সিগারেট ধরিয়ে ওনার আঙ্গুলের মাঝে গুঁজে দিচ্ছিল i
ঘনাদা বললেন , এবার শোনো তুতেনখামনের গল্পটা তোমাদের শোনালাম কেন i তোমরা জানতে আমি পিসির মৃত্যু সংবাদ পেয়ে বর্ধমান গেছি ওনার সব সম্পত্তির বিলি ব্যবস্থা করতে i সব হয়ে যাওয়ার পর আমি পিসির ঠাকুরের আসনে সেই চৌকো স্ফটিকটা পাই চন্দন সিন্দুর মাখানো অবস্থায় , আসলে পিসি ওটাকে ঠাকুর ভেবে শালগ্রাম শিলার মত পুঁজো করত i শুনেছিলাম পিসির এক দূর সম্পর্কের ভাশুর নাকি এক সময় ইজিপ্টের কোন এক পিরামিডের কিউরেটর ছিলেন , ওনারও পিসি ছাড়া আগে পিছে কেউ ছিল না i তাই মারা যাওয়ার আগে অসুস্থ অবস্থায় কিছু দিন বর্ধমানে পিসির কাছে ছিলেন i বর্ধমানেই উনি মারা যান i মারা যাওয়ার আগে উনি একটা চৌকো স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো বস্তু পিসিকে দিয়ে যান , আর বলে যান এটা একটা পৃথিবীর ইতিহাস যত্ন করে রেখে দিও i সেই থেকে পিসি ওই বস্তুটিকে
ঠাকুর জ্ঞানে ঠাকুরের আসনে রেখে সিন্দুর চন্দন ফুল বেলপাতা দিয়ে পুঁজো করতেন i আমার কি রকম সন্দেহ হলো , আমি তখন স্ফটিকটাকে ভালো করে
ধুয়ে পরিষ্কার করে একটা আতস কাচ দিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখলাম পুরো চৌকো স্ফটিকটার গায় কত রকমের ছবি আকা , কোনটা ঘোড়ার মাথা
ওয়ালা মানুষ লুঙ্গির মত কাপড় পরা , কত রকমের জীব জন্তু , বড় বড় লম্বা লম্বা হারির মতো বস্তু , বুঝলাম এই ছবিগুলোই ইজিপ্সিয়ান হরফ , বস্তুটাতে
নিশ্চয়ই অনেক কিছু লেখা আছে i আমি কাউকে কিছু না বলে স্ফটিকটা নিয়ে সোজা দিল্লি চলে গেলাম , ওখানকার ফরেন মিনিস্ট্রিতে মিশরীয় ডেস্কের ভার
প্রাপ্ত আধিকারিকের সাহায্যে একজন ইজিপ্সিয়ান ভাষা বিদকে দিয়ে পুরো ব্যাপারটা বুঝে নোট করে নিলাম i সেই গল্পটাই আজ তোমাদের বললাম i
আমি এখন খুব ব্যাস্ত , কি করে কম্পুটারের external হার্ড ডিস্কের সাথে এই স্ফটিকটার সংযোগ ঘটিয়ে এটার মধ্যে থাকা পুরো ভিডিও টাকে কম্পুটারে
ট্রান্সফার করাতে পারি, সেটা নিয়েই মাথা ঘামাচ্ছি i স্ফটিকটার মধ্যে থাকা ফাইলটা ওপেন করতে পারলে পৃথিবীর ইতিহাসে একটা আলোড়ন পড়ে যাবে i
তাই তোমরা আমাকে খুব বেশি একটা বিরক্ত করো না i এই বলে ঘনাদা উঠে দাড়ালেন, আর যেন আনমনে শিশিরের রাখা পুরো ডানহিল সিগেরেটের
প্যাকেট টা নিয়ে চটির ফট ফট আওয়াজ করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে চিলে কোঠায় উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন i আর এদিকে বসার ঘরে তখন
পিন পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছিলো আমাদের সকলের এমনি অবস্থা i পঞ্চু আর তাপস এই প্রথম ঘনাদার বাণী শুনলো , ওরা কেমন হতভম্ভের মত ফ্যাল ফ্যাল করে ইজি চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে আছে i
সকলে হটাৎ চমকে গেলাম ঠাকুরের গলার আওয়াজে .... চা হয়ে গেছে, তোমরা সকলে চা খেতে এসো, আমি বড় বাবুর চা টা ওপরে দিয়ে আসছি i
কখন যে বিকেল হয়ে গেছে আমরা কেউ বুঝতেও পারিনি i ...........
********** সমাপ্ত ************