গত পরশু তিনি ৬৫ বছরে পা দিলেন। জন্ম ওড়িশার ময়ূর্ভঞ্জ জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র সাঁওতাল পরিবারে। সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত গ্রামের স্কুলেই পড়াশোনা। ওই বয়সেই সবসময় মাথায় ঘুরত, এগোতে হবে, অনেকদূর এগোতে হবে। পড়াশোনা করে বড় হয়ে চাকরি করে সংসারের হাল ধরতে হবে।
একদিন ওই অঞ্চলে এক মিটিং এ রাজ্যের এক মন্ত্রী এলেন। সদ্য সপ্তম শ্রেণীতে ওঠা মেয়েটি সে সময়ের ম্যাট্রিক পাশ ঠাকুমার অনুপ্রেরণায় এবং বাবার পরামর্শে নিজের সমস্ত সার্টিফিকেট নিয়ে ছুটে গেল মন্ত্রীর কাছে। মিটিং এর মাঝেই দৌড়ে হলে প্রবেশ করে মন্ত্রীর হাতে সার্টিফিকেটগুলো জমা করে কাতর স্বরে বলল, আমি আরও পড়তে চাই। শহরের ভাল স্কুলে পড়াশোনা করতে চাই। মন্ত্রীর উদ্যোগে মেয়েটি প্রথমবার দেখল শহর, ভর্তি হল শহরের স্কুলে। কলেজের গণ্ডি ও পার করলেন। পড়াশোনা শেষ করে 'সাঁওতাল পরিবারের মেয়ে চাকরি করবে' সুলভ অজস্র কটুবাক্য নীরবে মাথায় নিয়ে যোগ দিলেন চাকরিতে।
ইতিমধ্যে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের আধিকারিক শ্যামচরণ মূর্মুর সাথে। প্রত্যাশিতভাবেই, বাড়ির বউ চাকরি করবে, এতে শ্বশুরবাড়ির ছিল ঘোর আপত্তি। ছেড়ে দিলেন চাকরি। ঠিক এসময় কোল আলো করে আসে পরপর দু'টি পুত্র এবং একটি কন্যাসন্তান। ছেলেমেয়েরা একটু বড় হতে আর পাঁচজন ভারতীয় মহিলার মতোই পরিবারের সাথে একটু 'মানিয়ে গুছিয়ে' নিয়ে আবার যোগ দিলেন একটি স্কুলের চাকরিতে, তবে এবার বিনা বেতনে। অনারারি সার্ভিস। পড়ানোর দক্ষতা এবং সবার সাথে মিশে যাওয়ার অপরিসীম ক্ষমতার সৌজন্যে স্বল্প সময়েই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন স্কুলের ছাত্রছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকদের মধ্যে। করতে থাকেন সমাজসেবামূলক কাজ।
এসময় সেই মন্ত্রীর এক বন্ধু রাজনীতিকের নজরে পড়ে দ্রৌপদীর কাজকর্ম। তিনি ক্রমাগত দ্রৌপদীকে অনুরোধ করতে থাকেন রাজনীতিতে যোগ দিতে যাতে তাঁর জনপ্রিয়তার ওপর ভর করে ভোট বৈতরণী পার হওয়া যায়। দ্রৌপদী নাছোড়বান্দা। রাজনীতির বাইরে থেকেই সমাজের জন্য কাজ করতে চান। ক্রমাগত অনুরোধ উপোরধ শেষে আর নাকচ করতে না পেরে স্বামীর পরামর্শে ১৯৯৭ সালে ময়ূর্ভঞ্জের নোটিফায়েড এরিয়া কাউন্সিলের কাউন্সিলর পদে নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন জমা দেন ভারতীয় জনতা পার্টির হয়ে এবং বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। প্রথমবার কাউন্সিলর হয়েই ওই বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান পদে মনোনীত হন।
কাউন্সিলর পদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই ২০০০ সালে দলের অনুরোধে বিজেপি-বিজেডি জোটের হয়ে মনোনয়ন জমা দেন বিধানসভা নির্বাচনে। মানুষের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা থাকায় জিতেও যান। প্রথমবার বিধায়ক হয়েই মনোনীত হন পরিবহন দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী।
এবার এল আসল চ্যালেঞ্জ। এক সাঁওতাল মহিলা মন্ত্রীত্ব সামলাবেন! তাবড় আইএএস অফিসার, দফতরের কর্মীদের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে দিনরাত পড়াশোনা করে কিছুদিনের মধ্যেই কাজের গতিপ্রকৃতি বুঝে নিলেন। চার বছরে চারটি দফতরের মন্ত্রীত্ব সামলালেন।
২০০৪ এর বিধানসভা নির্বাচনে জোট ভেঙে গেল। বিজেপির ভরাডুবি হল নবীন পত্তনায়কের বিজেডির কাছে। এই কঠিন সময়েও দ্রৌপদী মুর্মু বিজেপির টিকিটেই আবার বিধায়ক হলেন। কিন্তু হেরে গেলেন ২০০৯ এর বিধানসভায়। শহরে পাঠরত দুই ছেলেকে বললেন, তোমরা ভুবনেশ্বরে থেকেই পড়াশোনা করো, আমি আবার গ্রামে ফিরে গিয়ে তৃণমূল স্তরে মানুষের জন্য কাজ করতে চাই আগের মতো।
পুরনো গ্রামে ফিরে আবার ডুবে গেলেন সমাজসেবার কাজে।
কিছুদিনের মধ্যেই এক সকালে খবর পেলেন বড় ছেলে আর নেই। ভেঙে পড়লেন শোকে। সামলে ওঠার জন্য ডুবে গেলেন কাজের মধ্যে আরও বেশি করে।
২০১৪ র এক অভিশপ্ত রাতে ছোটছেলেটিও একটি পথ দুর্ঘটনায় চলে গেল কোল খালি করে। স্বামী-স্ত্রী দু'জনেই তীব্র মানসিক অবসাদে ডুবে গেলেন। স্ত্রীর স্নায়বিক শক্তি অসীম হলেও পুত্রশোক নিতে পারেননি স্বামী। কিছুদিনের মধ্যেই তিনিও পরলোকগমন করলেন। তার কয়েকদিনের মধ্যেই দ্রৌপদীর মা ও দাদা। এক বছরে এতগুলো মৃত্যু মেনে নিতে পারলেন না তিনি। শেষ অবলম্বন হিসাবে জড়িয়ে ধরলেন যোগ এবং আধ্যাত্বিকতাকে, সাথে আরো বেশি করে নিজেকে নিয়োজিত করলেন সমাজের কাজে। স্বামীসন্তানহারা এক মা ছাতা হয়ে উঠতে চাইলেন অনেক অনেক আদিবাসী সন্তানের।
এরমধ্যেই ২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল হিসাবে দ্রৌপদীকে মনোনীত করলেন। আদিবাসী অধ্যুষিত ঝাড়খণ্ডের প্রথম মহিলা রাজ্যপাল এবং ওড়িশা থেকে উঠে আসা প্রথম আদিবাসী রাজ্যপাল হিসাবে যোগ দিলেন কাজে। সসম্মানে দায়িত্ব সম্পূর্ণ করে ২০২১ এ অবসর নেন। ফিরে আসেন ওড়িশায়।
আর কিছুদিনের মধ্যেই চিরাচরিত রাজনৈতিক কলিমাহীন এহেন শক্তিশালী এক ভারতীয় নারীর মুকুটে যুক্ত হতে চলেছে চূড়ান্ত পালকটি। তিনিই হতে চলেছেন ভারতবর্ষের প্রথম মূলনিবাসী এবং দ্বিতীয় মহিলা রাষ্ট্রপতি। সাথে তিনিই হতে চলেছেন প্রথম রাষ্ট্রপতি যাঁর জন্ম স্বাধীনতার পরে।
একদা সন্তানশোকে বিহ্বল এক মা হতে চলেছেন একশ' ত্রিশ কোটি ভারতবাসীর অভিভাবক! এটাই ভারতবর্ষ। এঁরাই ভারতবর্ষ।
'আদিবাসী অধ্যুষিত রাজ্যের আগত বিধানসভা ভোটের জন্য খুড়োর কল', 'আদিবাসী কার্ড', 'কোটার রাষ্ট্রপতি' ইত্যাদি সমালোচনা তো চলতেই থাকবে এবং এই আলোচনা যত চলবে, গণতান্ত্রিক পরিসর তত প্রশস্ত হবে। তবে এইসব কচকচানির বাইরে গিয়ে আশা রাখা যায় একাধারে আরও অনেক প্রিভিলেজড এবং প্রান্তিক, অসংরক্ষিত এবং জনজাতিভুক্ত রমণীর অনুপ্রেরণা হয়ে ধরা দেবেন এই আটপৌরে শুভ্রবস্ত্র আদিবাসী মা, দ্রৌপদী মুর্মু।
একদিন ওই অঞ্চলে এক মিটিং এ রাজ্যের এক মন্ত্রী এলেন। সদ্য সপ্তম শ্রেণীতে ওঠা মেয়েটি সে সময়ের ম্যাট্রিক পাশ ঠাকুমার অনুপ্রেরণায় এবং বাবার পরামর্শে নিজের সমস্ত সার্টিফিকেট নিয়ে ছুটে গেল মন্ত্রীর কাছে। মিটিং এর মাঝেই দৌড়ে হলে প্রবেশ করে মন্ত্রীর হাতে সার্টিফিকেটগুলো জমা করে কাতর স্বরে বলল, আমি আরও পড়তে চাই। শহরের ভাল স্কুলে পড়াশোনা করতে চাই। মন্ত্রীর উদ্যোগে মেয়েটি প্রথমবার দেখল শহর, ভর্তি হল শহরের স্কুলে। কলেজের গণ্ডি ও পার করলেন। পড়াশোনা শেষ করে 'সাঁওতাল পরিবারের মেয়ে চাকরি করবে' সুলভ অজস্র কটুবাক্য নীরবে মাথায় নিয়ে যোগ দিলেন চাকরিতে।
ইতিমধ্যে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের আধিকারিক শ্যামচরণ মূর্মুর সাথে। প্রত্যাশিতভাবেই, বাড়ির বউ চাকরি করবে, এতে শ্বশুরবাড়ির ছিল ঘোর আপত্তি। ছেড়ে দিলেন চাকরি। ঠিক এসময় কোল আলো করে আসে পরপর দু'টি পুত্র এবং একটি কন্যাসন্তান। ছেলেমেয়েরা একটু বড় হতে আর পাঁচজন ভারতীয় মহিলার মতোই পরিবারের সাথে একটু 'মানিয়ে গুছিয়ে' নিয়ে আবার যোগ দিলেন একটি স্কুলের চাকরিতে, তবে এবার বিনা বেতনে। অনারারি সার্ভিস। পড়ানোর দক্ষতা এবং সবার সাথে মিশে যাওয়ার অপরিসীম ক্ষমতার সৌজন্যে স্বল্প সময়েই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন স্কুলের ছাত্রছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকদের মধ্যে। করতে থাকেন সমাজসেবামূলক কাজ।
এসময় সেই মন্ত্রীর এক বন্ধু রাজনীতিকের নজরে পড়ে দ্রৌপদীর কাজকর্ম। তিনি ক্রমাগত দ্রৌপদীকে অনুরোধ করতে থাকেন রাজনীতিতে যোগ দিতে যাতে তাঁর জনপ্রিয়তার ওপর ভর করে ভোট বৈতরণী পার হওয়া যায়। দ্রৌপদী নাছোড়বান্দা। রাজনীতির বাইরে থেকেই সমাজের জন্য কাজ করতে চান। ক্রমাগত অনুরোধ উপোরধ শেষে আর নাকচ করতে না পেরে স্বামীর পরামর্শে ১৯৯৭ সালে ময়ূর্ভঞ্জের নোটিফায়েড এরিয়া কাউন্সিলের কাউন্সিলর পদে নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন জমা দেন ভারতীয় জনতা পার্টির হয়ে এবং বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। প্রথমবার কাউন্সিলর হয়েই ওই বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান পদে মনোনীত হন।
কাউন্সিলর পদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই ২০০০ সালে দলের অনুরোধে বিজেপি-বিজেডি জোটের হয়ে মনোনয়ন জমা দেন বিধানসভা নির্বাচনে। মানুষের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা থাকায় জিতেও যান। প্রথমবার বিধায়ক হয়েই মনোনীত হন পরিবহন দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী।
এবার এল আসল চ্যালেঞ্জ। এক সাঁওতাল মহিলা মন্ত্রীত্ব সামলাবেন! তাবড় আইএএস অফিসার, দফতরের কর্মীদের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে দিনরাত পড়াশোনা করে কিছুদিনের মধ্যেই কাজের গতিপ্রকৃতি বুঝে নিলেন। চার বছরে চারটি দফতরের মন্ত্রীত্ব সামলালেন।
২০০৪ এর বিধানসভা নির্বাচনে জোট ভেঙে গেল। বিজেপির ভরাডুবি হল নবীন পত্তনায়কের বিজেডির কাছে। এই কঠিন সময়েও দ্রৌপদী মুর্মু বিজেপির টিকিটেই আবার বিধায়ক হলেন। কিন্তু হেরে গেলেন ২০০৯ এর বিধানসভায়। শহরে পাঠরত দুই ছেলেকে বললেন, তোমরা ভুবনেশ্বরে থেকেই পড়াশোনা করো, আমি আবার গ্রামে ফিরে গিয়ে তৃণমূল স্তরে মানুষের জন্য কাজ করতে চাই আগের মতো।
পুরনো গ্রামে ফিরে আবার ডুবে গেলেন সমাজসেবার কাজে।
কিছুদিনের মধ্যেই এক সকালে খবর পেলেন বড় ছেলে আর নেই। ভেঙে পড়লেন শোকে। সামলে ওঠার জন্য ডুবে গেলেন কাজের মধ্যে আরও বেশি করে।
২০১৪ র এক অভিশপ্ত রাতে ছোটছেলেটিও একটি পথ দুর্ঘটনায় চলে গেল কোল খালি করে। স্বামী-স্ত্রী দু'জনেই তীব্র মানসিক অবসাদে ডুবে গেলেন। স্ত্রীর স্নায়বিক শক্তি অসীম হলেও পুত্রশোক নিতে পারেননি স্বামী। কিছুদিনের মধ্যেই তিনিও পরলোকগমন করলেন। তার কয়েকদিনের মধ্যেই দ্রৌপদীর মা ও দাদা। এক বছরে এতগুলো মৃত্যু মেনে নিতে পারলেন না তিনি। শেষ অবলম্বন হিসাবে জড়িয়ে ধরলেন যোগ এবং আধ্যাত্বিকতাকে, সাথে আরো বেশি করে নিজেকে নিয়োজিত করলেন সমাজের কাজে। স্বামীসন্তানহারা এক মা ছাতা হয়ে উঠতে চাইলেন অনেক অনেক আদিবাসী সন্তানের।
এরমধ্যেই ২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল হিসাবে দ্রৌপদীকে মনোনীত করলেন। আদিবাসী অধ্যুষিত ঝাড়খণ্ডের প্রথম মহিলা রাজ্যপাল এবং ওড়িশা থেকে উঠে আসা প্রথম আদিবাসী রাজ্যপাল হিসাবে যোগ দিলেন কাজে। সসম্মানে দায়িত্ব সম্পূর্ণ করে ২০২১ এ অবসর নেন। ফিরে আসেন ওড়িশায়।
আর কিছুদিনের মধ্যেই চিরাচরিত রাজনৈতিক কলিমাহীন এহেন শক্তিশালী এক ভারতীয় নারীর মুকুটে যুক্ত হতে চলেছে চূড়ান্ত পালকটি। তিনিই হতে চলেছেন ভারতবর্ষের প্রথম মূলনিবাসী এবং দ্বিতীয় মহিলা রাষ্ট্রপতি। সাথে তিনিই হতে চলেছেন প্রথম রাষ্ট্রপতি যাঁর জন্ম স্বাধীনতার পরে।
একদা সন্তানশোকে বিহ্বল এক মা হতে চলেছেন একশ' ত্রিশ কোটি ভারতবাসীর অভিভাবক! এটাই ভারতবর্ষ। এঁরাই ভারতবর্ষ।
'আদিবাসী অধ্যুষিত রাজ্যের আগত বিধানসভা ভোটের জন্য খুড়োর কল', 'আদিবাসী কার্ড', 'কোটার রাষ্ট্রপতি' ইত্যাদি সমালোচনা তো চলতেই থাকবে এবং এই আলোচনা যত চলবে, গণতান্ত্রিক পরিসর তত প্রশস্ত হবে। তবে এইসব কচকচানির বাইরে গিয়ে আশা রাখা যায় একাধারে আরও অনেক প্রিভিলেজড এবং প্রান্তিক, অসংরক্ষিত এবং জনজাতিভুক্ত রমণীর অনুপ্রেরণা হয়ে ধরা দেবেন এই আটপৌরে শুভ্রবস্ত্র আদিবাসী মা, দ্রৌপদী মুর্মু।