একসময় বই পড়ার খুব ঝোক ছিল জিতুর। প্রচুর বই পড়া হত। অনেক দিন নতুন কোনও বই পড়ে না। অনেক বছর আগে কোনও এক বইয়ে জিতু পড়েছিল, “মানুষের মনের উপর আকাশের প্রভাব রয়েছে।“ কথাটার সাথে ও সবসময়ই একমত ছিল। অনেক দিন পর আজকে আবার অনুভব করল কথাটা। অনেকদিন পর কারণ, বহুদিন আকাশ দেখার সুযোগ হয় নি জিতুর। মুক্ত খোলা আকাশের যে কি সৌন্দর্য, সেটা যে সবসময় খোলা আকাশ দেখে সে কোনও দিন বুঝবে না। জিতুর মত লোকেরাই বুঝতে পারবে।
দীর্ঘ আটটি বছর। কত দ্রুত কেটে গেল দীর্ঘ আটটি বছর। তখন ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে বেরিয়েছে কেবল জিতু। কয়েকমাস হল ভাল একটা চাকরিও পেয়ে গেছিল। ফ্রেশার হিসেবে ভালই মাইনা পেত। সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছিল জিতুর সামনে, সবাই তাই বলতো। অন্তত জিতু নিজে সেটুকু বিশ্বাস করতোই। কিন্তু ভবিষ্যৎ যে কেবল সময়ের মধ্যেই থাকে। কেবল সময়ই যে জানে যে ভবিষ্যতে কি লেখা রয়েছে। এই লেখা প্রাচীণ কোনোও ভাষার চাইতেও দুর্বোধ্য। বুঝতে হলে সেই সময়কালে উপস্থিত হওয়া চাই। নাহলে এর অর্থ বোঝা যায় না।
রাস্তায় একটু আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে। রাস্তা হালকা কাদা কাদা। এদিকে সেদিকে ময়লা পানি জমে আছে। হাটতে গেলে পায়ের জুতার তলায় বাড়ি খেয়ে কিছু নোংরা পানি উঠে প্যান্টের পেছনটায় লাগছে। মনে মনে হাসল জিতু। সময় যায়, মানুষের কিছু বৈশিষ্ট্য বদলে যায় না। প্রথমে মায়ের কাছে, এরপর বৌদির কাছে কত বকা শুনেছে একসময় এই নিয়ে জিতু। প্যান্টের পেছনের অংশটুকু নোংরা হত বৃষ্টির মৌসুমে হড়কা পানিতে লেগে। সেই কথাই স্মরণ করল জিতু। খুব বকত মা, এরপর বৌদি।
একটু নিরিবিলি জায়গায় এসে একটা চায়ের দোকান দেখে সেদিকে এগিয়ে গেল জিতু। চায়ের দোকানে বসল। আশেপাশে তেমন কোনও উত্তেজনা নেই। অথচ ওর কাছে সব নতুন লাগছে। এমনকি একটা সামান্য চায়ের দোকানে বসাটাও নতুন লাগছে। দোকানদারের দিকে ফিরে বলল, “দাদা একটা চা দিন তো, ভাড়ে। দুধ দিয়ে, চিনি ছাড়া।“
“বসুন, দিচ্ছি। আর কিছু লাগবে দাদা?” চা ওয়ালা বলল।
“হ্যা একটা সিগারেট ছাড়ুন।“
দোকানদার একটি সিগারেটের শলাকা বের করে দিল জিতুকে। হাতে নিয়ে সিগারেটটির দিকে এক পলক তাকিয়ে রইল। দুই ঠোঁটের ফাঁকে কামড়ে ধরল সিগারেটের ফিল্টার। চায়ের দোকানে ঝুলতে থাকা লাইটারটা ডান হাতে ধরে বাম হাতের আড়ালে শিখা জ্বালিয়ে সিগারেটটা টান দিয়ে এক বুক ধোঁয়া টেনে ধোঁয়াটা বাতাসে ভাসালো জিতু। বাতাস ঘোলা করে তুললো সেই ধোঁয়া। চোখগুলোও কি একটু ঘোলাটে হয়ে উঠলো? দৃষ্টিও কি একটু ঝাপসা হয়ে এলো? ঘা শুকিয়ে যায় কিন্তু দাগ থেকে যায়।
বসে বসে সিগারেটটিকে ছাই এ পরিণত করতে লাগল আর স্মৃতিচারণ করতে লাগল জিতু। অর্ধেক অবধি শেষ করে ভাবতে লাগল জিতু, “এইযে অর্ধেক সিগারেট, এই অংশটুকু তো তোর ভাগের, রঞ্জন। কে শেষ করবে এটুকু?” কোথায় আজকে রঞ্জন? কোথায় আজকে সন্ধ্যা? কিচ্ছু জানা নেই জিতু।
জীবন একটি রোলারকোস্টার। জীবনের প্রায় সাড়ে তিন দশক পার করে এসে এটা এইবার হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে জিতু। কোথাকার জীবন কোথা থেকে মুহূর্তের মধ্যে কোথায় টেনে নিয়ে আসে। সিগারেটটা শেষ করে চায়ের দোকানে খুচরো কিছু পয়সা দিয়ে বিল মিটিয়ে দিল জিতু। কিন্তু দোকান থেকে উঠে গেল না। এখানে বসে বসে ভাবতে ভালই লাগছে ওর।
জিতুরা ছিল ৪ ভাই ৪ বোন। জিতুই সবার ছোট। জিতুর বড় দাদার সাথে জিতুর বয়সের পার্থক্য অনেক। তাই বড় বৌদিও জিতুর কাছে তার মায়ের মতই ছিল। জিতু যখন প্রাইমারিতে সবে ভর্তি হবে তখনই জিতুর মা মারা যান। এরপর মা বলতে জিতু বড় বৌদিকেই বুঝত। জিতুর বড় বৌদির একটাই ছেলে, রঞ্জন। জিতুর চাইতে বছর তিনেক ছোট। সম্পর্কে কাকা ভাইপো হলেও দুজনের বয়স পিঠাপিঠি হওয়ায় একদম মানিকজোড় ছিল। জিতু তার বড়দাদা অর্থাৎ রঞ্জনের বাবা মায়ের কাছেই বড় হয়েছে। রঞ্জন সবসময়ই একটু চুপচাপ স্বভাবের ছিল। অন্যদিকে জিতু বরাবরই প্রাণবন্ত, চঞ্চল। যেকোনও কাজেই জিতু পারদর্শী। তাই সবাই রঞ্জনের চাইতে জিতুকে একটু বেশি পছন্দ করত। কিন্তু এই ব্যাপারটা কখনও রঞ্জনের মনে হিংসা-বিদ্বেষ এর জন্ম দেয় নি।
দুজনের মধ্যে কখনও কোনও ক্লেশ ছিল না। একজন বয়সে বড় হলেও আরেকজনের উপর কোনও খবরদারি বা শাসন করত না। কেমন যেন একটা বোঝাপড়া ছিল দুজনের মধ্যেই। ওদের দুজনকে কেউ কখনও লড়াই বিবাদ করতে দেখে নি। অদ্ভুত মিল ছিল দুজনের মধ্যেই। অনেকটা ক্রাইম পার্টনার এর মত সম্পর্কই বেশি প্রতীয়মান হত দুজনের মধ্যে, কাকা ভাতিজার সম্পর্ককে ছাপিয়ে।
দুজনের মধ্যে মিলটা এতোই বেশি ছিল যে, রঞ্জনের মাধ্যমিকের মূল্যায়ন পরীক্ষা খারাপ হবার পর সারারাত দুজনে মিলে সিগারেট ফুঁকেছিল। এমনকি রঞ্জনের মদ্যপ্রাসন ও জিতুর সাথেই। যেখানে রঞ্জন আটকে যেত সেখানে জিতু সামলে নিত। আবার যেখানে জিতুর বিপদ ছিল সেখানে রঞ্জন কাজে আসত। তারা দুজনই দুজনের সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিল। রঞ্জনের মা সবসময় বলত, “রঞ্জু আর জিতু বোবা হলেও একে অপরের সাথে কথা বলে যেতে পারবে সারাক্ষণ।“
সত্যিই তাই। দুজনের টিউনিং এরকম ই ছিল। কখনও এরম হয় নি যে এরা একজন আরেকজনের সাথে নিজেদের ব্যাপারের কোনও কথা গোপন রেখেছে। কাকা ভাতিজা দুজনের কাছে দুজন যেন খোলা বই ছিল। অন্ধকারেও একে অন্যকে পড়তে পারত।
জিতু চায়ের দোকানে বসে বসে আরেকটা সিগারেট ধরালো। রঞ্জনের কথা খুব মনে পড়ছে। রঞ্জনকে সে কতটাই না ভালবাসত। স্কুলে থাকতে একবার ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে কিছু ছেলে রঞ্জনকে চড় মেরেছিল। খবর পেয়ে জিতু ছুটে গিয়েছিল ফুটবল খেলার মাঠে। রাগে দুঃখে তখন জিতুর শরীর কাপছে আর চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। একাই গিয়ে সবগুলো ছেলের উপর চড়াও হয়েছিল সেদিন জিতু। নিজেও বেধরক মার খেয়েছিল। তবুও লড়ে গেছিল রঞ্জনের জন্য।
রঞ্জনকে নিজের জীবনের চাইতেও বেশি ভালবাসত জিতু। এখনও ভালবাসে। কিন্তু সেই রঞ্জন আজকে কোথায়? কোথায় আছে রঞ্জন? কোথায় গেলে পাবে সে রঞ্জনকে? কি করে এই ঘটনাটি ঘটল জানে না জিতু। রঞ্জনকে ফিরে পাবার জন্য জীবন থেকে আরও আটটি বছর দিয়ে দিতে রাজি আছে জিতু। যদি এতে রঞ্জনকে আবার পাওয়া যায়, তাহলে তার এতে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু সব চাওয়া বিধাতা সব সময় পূরণ করেন না।
রঞ্জন আর জিতু একই স্কুল কলেজে পড়েছে। কলেজ শেষে জিতু সিদ্ধান্ত নিল সে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হবে। জিতুর প্রথম থেকেই পছন্দ ছিল সাহিত্য। সে কাকাকে প্রতিটা ক্ষেত্রে ফলো করলেও এই দফা সে নিজের ইচ্ছে মত পথে হাটল। শহরের বাইরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে গেল জিতু। রঞ্জন তখনও উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষা দেয় নি। নিয়মিত তাদের দুজনের মধ্যে ফোনে কথা হত। সেখানের আবহাওয়া কেমন, বন্ধুবান্ধব কেমন, মেয়েরা কেমন দেখতে, কোনও বান্ধবী জুটিয়েছে কি না এধরনের নানা রকম কথোপকথন চলতেই থাকতো দুজনের মধ্যে। জিতুও নানা রকম তথ্য দিয়ে এবং রসিয়ে গল্প বলে উৎসাহিত করত রঞ্জনকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য। কিন্তু রঞ্জন সেসব শুনে পুলকিত হলেও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বার ইচ্ছা তার মধ্যে কখনও জন্মায় নি।
রঞ্জন নিজের মত করে বড় হতে থাকে। কাকা তার রোলমডেল। কিন্তু কাকার সাথে তার মিল বলতে গেলে প্রায় নেয় ই। কিন্তু সম্পর্কটা রক্ত ছাড়িয়ে আত্মায় পৌঁছে গেছে।
এরম করেই হাওয়ায় দিন ভেসে যেতে থাকে দুজনের। জিতুর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া এগিয়ে চলছে। রঞ্জন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মাঝে বছরে দুবার করে বাড়িতে এসে বেড়িয়ে গেছে জিতু। এর মধ্যে জিতুর নতুন আরেকটি গুণ সবার কাছে প্রকাশিত হয়েছে। জিতু আগের থেকেই মেশিন পত্রের ব্যাপারে ওস্তাদ ছিল। এখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়ে হাতেকলমে বহু জিনিস ব্যবহার করে ওদের কমপ্লেক্সের ইঞ্জিনিয়ার বনে গেছে। জিতু ছুটিতে বাড়ি এলে বিশাল একটা সময় ব্যয় করে নিজেদের এবং এর ওর বাড়ির বিভিন্ন মেশিনের ত্রুটি সারাতে। ইলেক্ট্রিসিটির সকল কাজে সে ওস্তাদ। ফলাফলে সবার জিতুর প্রতি আগ্রহ আগের চাইতে আরও বেড়ে যাচ্ছিল।
ব্যাপারটাকে জিতু সবসময় রঞ্জনের কাছে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করত। রঞ্জনও খুব গর্ববোধ করত তার কাকাকে নিয়ে। রঞ্জন সবসময় মনে প্রাণে বিশ্বাস করত তার কাকা এই পৃথিবীর সেরা মানুষটির একটি। সেই বিশ্বাসের আগুনে অন্যদের থেকে জ্বালানী এলে রঞ্জনের বুকটা গর্বে আধ হাত ফুলে উঠত বৈ কি।
এরমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় এলো। রঞ্জন ওর কাকা কে বলল, “কাকা, তোর সাথে কথা বলবার ছিল যে আমার।“
“তোর আমার সাথে আবার কথা বলবার দরকার হল কবে থেকে রে?”
“এরম করে বলছিস কেন? আমরা কি কথা বলি না?”
“বলি। তবে সেটা সময় কাটাতে। মনের ইচ্ছে জানানোর জন্য না। সেটা আমরা এমনিই বুঝতে পারি, তাই নারে? আমি জানি তুই কি বলতে চাস। তুই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাইছিস না, তাই তো?”
“হ্যা কাকা। আমার ভাল লাগে না এসব। আমার সাহিত্য ভাল লাগে, তুই তো জানিস ই।“
“লেহ, হয়ে গেল। সাহিত্যই পড়। এ আর এমন কি? দেখ রঞ্জু, কি পড়ছিস সেটার চেয়েও জরুরী হচ্ছে পড়ছিস কি না। প্রোগ্রেসটাই আসল। আর কিচ্ছু না। তুই একদম কিচ্ছুটি চিন্তা করিস না। আমি বড়দা আর বৌদির সাথে কথা বলে নেব। সব ম্যানেজ করে নেব। কিচ্ছু চিন্তা করিস না তুই। কিন্তু একটা শর্ত আছে কিন্তু।“
“কি শর্ত?” একটু ঘাবড়ে গেল রঞ্জন শর্তের কথা শুনে।
“এই তেমন কিছুই না। তোকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হতে হবে। আমি জানি আমার রঞ্জু এটা পারবে। পারবি না রে?”
“তুমি বললে কাকা আমি ছাদ থেকে লাফ ও দিতে পারি।“
হেসে উঠল জিতু, জানে সে। রঞ্জন ওর জন্য সব করতে পারে।
রঞ্জন শহরের মধ্যেই একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেল বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করতে। বছর খানেক যেতে না যেতেই পরীক্ষা এসে কড়া নারল সামনে। বলা বাহুল্য, রঞ্জন টপ করে প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষতে প্রোমশন পেল। এরমধ্যে জিতুর গ্রাজুয়েশন শেষ হয়ে গেছে। ইন্টার্ন করবার জন্য একটা কম্পানিতে ইন্টার্নশীপ করতে জিতুও ঘরে ফিরে এসেছে।
রঞ্জনের খুশি এবার দেখে কে। এবার কাকা তার কাছে থাকবে। কত রকমের কথা বলা লাগে কাকার সাথে। অতো কথা ফোনে বলা যায় নাকি? রোজ ক্লাস সারাদিন, ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ানোর চেষ্টা, এর ওর সাথে ইন্ট্রোভার্ট রঞ্জনের মেশার আকাঙ্ক্ষা আর রাতে অফিস ফেরত কাকার সাথে ঘরে বসে সিগারেট ফোঁকা আর ধুন্দুমার আড্ডা, উইকেন্ডে মদ গেলা। এই চলছিল দুজনের জীবনে। জিতু তিনমাসের ইন্টার্ন সেরে সেই কম্পানিতেই একটা মোটা বেতনের চাকরি পেয়ে গেল। খুব একটা সহজ বিষয় না এটা। বেশ বিরল ঘটনাই। কিন্তু কপালে থাকলে ঠেকায় কে? তাই হয়েই গেল।
যেদিন জিতুর চাকরি কনফার্ম হয় সেদিন রঞ্জনের ক্যাম্পাসে একটা অনুষ্ঠান ছিল। সেই অনুষ্ঠানে রঞ্জনের রচনা করা একটি নাটক মঞ্চস্থ করা হয়। রঞ্জন শুধু চিত্রনাট্য আর স্ক্রিপ্ট লিখেছিল। সাধারণত এসব অনুষ্ঠান রঞ্জন এরিয়ে চলে। কিন্তু সে আস্তে আস্তে বুঝল, এসব অনুষ্ঠানে না গেলে তার জ্ঞান থেকে যাবে সীমিতই। তাই সেও অনুষ্ঠানে দর্শক হিসেবে অংশ নিল।
অনুষ্ঠানে রঞ্জনের আরও আগ্রহের কারণ হল, তার লেখা নাটকটা মঞ্চে কেমন লাগে সেটা দেখা। পাশাপাশি স্ক্রিপ্টটাও তো শুনতে হবে। ট্রাজিক রোমান্টিক ঘরানার একটি নাটকের সংলাপ লিখতে গিয়ে রঞ্জনের গাঁড় ফেটে গেছে।
একদম প্রথম সাড়িতেই বসল রঞ্জন। অনুষ্ঠান শুরু হতে এখনও বাকি। বিরক্তই লাগা শুরু হল রঞ্জনের। কিন্তু অনুষ্টান শুরু হতে রঞ্জনের মনোযোগ যে একবার স্টেজের দিকে গেল, আর সরলই না। রঞ্জন জানেই না পুরোটা অনুষ্ঠানের সময় ধরে মঞ্চে কি চলেছে। তার নজর শুধু আটকে আছে মঞ্চের উপর থাকা উপস্থাপিকার দিকে।
লাল পেড়ে সাদা শাড়ী পড়া কাধ অবধি ঢেউ খেলানো চুলের ফরসা সেই সাদাসিধে মেয়েটাকে তার অপূর্ব সুন্দরী মনে হচ্ছে। গলায় সাদা মুক্তার মালাটার উপর থেকে চোখ ই সরাতে পারছে না রঞ্জন। কি এক অদ্ভুত মোহে পড়ে গেছে যেন। মাথায় এলোমেলো কবিতা, উক্তি ঘুড়ে বেড়াতে শুরু করল ওর।
কবিতা লেখার লোক রঞ্জন না। কিন্তু কেমন যেন অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে রঞ্জনের সাথে। এই ধরনের অনুভূতির সাথে ইন্ট্রোভার্ট রঞ্জন একদমই পরিচিত নয়।
এক পর্যায়ে রঞ্জনের মনে হচ্ছিল এক্ষুনই হয়তো সে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মরে যাবে। যখন নাটকটা মঞ্চস্থ হতে যাচ্ছিল তখন সেই নাটকের রচয়িতা ও সংলাপ রচয়িতার নাম যখন পড়ল সেই সুন্দরী উপস্থাপিকা, রঞ্জনের মনে হচ্ছিল, এরকম কিছুর কাছে যেন সম্পূর্ণ জগতসংসার তুচ্ছ। একেকটি পরিবেশনার চাইতে উপস্থাপনার দিকেই রঞ্জনের মনোযোগ ছিল বেশি। কে তাকে বলেছিল চুলে রজনীগন্ধ্যার মালাটা আটকে নিতে? লাল টিপটারই বা কি দরকার ছিল? কানের অমন দুলগুলো কেন বারবার কাধের উপর এসে পড়া খোলা চুলের মাঝে ঝিকিয়ে উঠতে হবে?
গেল তো এবার কানের ঐ দুলে প্রাণ বিদ্ধ হয়ে?
এটাকে ক্রাশ বলে না প্রেম বলে না কি বলে, জানে না রঞ্জন। শুধু জানে ডুবে গেছে পুরো। কতক্ষণে কাকার সাথে দেখা করবে, এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবে এসব ভেবে চলেছে রঞ্জন। আবার অনুষ্ঠানটা সাময়িক, একটু পর শেষ হলেই মেয়েটিও হারিয়ে যাবে ভেবেও খারাপ লাগছে তার কাছে।
অনুষ্ঠান শেষে সেদিন অনেক দেরি করে বাড়ি ফিরল রঞ্জন। দেরি করে মূলত ফিরতে চায় নি। কিন্তু ক্লাসমেটদের সাথে থেকে দেরি হয়ে গেল। বাড়ী ফিরে দেখল, বাড়িতে কেমন একটা উৎসব উৎসব পরিবেশ রয়েছে। জানা গেল, জিতুর চাকরি কনফার্ম হয়েছে। রঞ্জনের খুশি আর দেখে কে। সেদিন রাতে জিতু ওদের সবাইকে বাইরে খাওয়াতে নিয়ে গেল। দীননাথ সেন রোডের শাহী বিরিয়ানি ওদের সবারই খুব প্রিয়।
ওর সাথে সারাদিন কাকার কথা বলবার সুযোগ হয় নি। ঘরে ফিরে চেঞ্জ করেই ছুটলো কাকার রুমে রঞ্জন। জিতুর রুমের দরজা ভেজানো। নক না করেই জিতুর রুমে ঢুকে গেল। জিতু দরজা খোলার শব্দে চমকে উঠল। জিজ্ঞেস করল, “কিরে, সিগারেট নেই?”
“থাকলেই বা কি। আমরা ভাগাভাগি করে সিগারেট খাই না?”
“হ্যা, আয়। আজকে এত্তো সুন্দর একটা দিন গেল আমার জন্য।“
“জানি। কাকা জানিস আমার দিনটাও আজকে অনেক সুন্দর গেছে।“
“হ্যা সে তো তোর চোখে মুখে চাপা উত্তেজনা থেকেই বুঝতে পারছি বেশ। কেস টা কি বলতো?”
“কাকা তোর ভাইপো প্রেমে পড়েছে রে।“
“হ্যাহ? বলিস কিরে? কে সেটা শুনি? কোথায় পেলি?”
“আরে কাকা সব বলব। এতো কিছু একসাথে জিজ্ঞেস করে নাকি।“
“নামটা তো বল।“
“সন্ধ্যা।“
এরপর রঞ্জন সব বলল। বলল, অনুষ্ঠানের শেষে ওর ক্লাসমেটরা ওকে ডেকেছিল ব্যাকস্টেজে। সেখানে ঐ মেয়েটা ওর সাথে কথা বলেছে। পরিচিত হয়েছে ও মেয়েটার সাথে। মেয়েটা সঙ্গীত বিভাগে পড়াশোনা করছে বর্ষে। কোনও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা যুক্ত হয় নি তবে ফোন নম্বর আদান প্রদান হয়েছে। হোয়াটসএপ এ কথা হবে বলেছে।
“ছবি আছে? হোয়াটসএপ ডীপি?” জিতু জানতে চাইল।
“না কোনও ডীপি দেওয়া নেই।“
“যাই হোক, রঞ্জু। জেনে খুব ভাল লাগল। দেখা করাবি কবে কাকার সাথে?”
“কাকা, বালের কথা বলিস না। নিজেই চিনি না এখনও। তোকে দেখা করাবো কি?”
“হাহাহা, আচ্ছা। কথা টথা বলে নে। পরে জানাস আমাকে।“
“সিগারেটের বাকি অর্ধেকটা দেবে তুমি বাঁড়া? নাকি একাই শেষ করবে?”
ঐ ঘটনার পর আরও বছর দুই কেটে গেল। এর মাঝে সন্ধ্যার সাথে রঞ্জনের সম্পর্ক অনেক দূর এগিয়ে গেছে। রীতিমত প্রেম করছে ওরা দুজন। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হল এইখানে যে, চাকরিটা হয়ে যাওয়ার কারণে সপ্তাহখানেকের মধ্যেই জিতুকে শহরের বাইরে চলে যেতে হয়। তাই জিতুর সাথে রঞ্জন চাইতেও সন্ধ্যার দেখা করাতে পারে নি। জিতুর সাথে বহুবার কথা হবার সময় রঞ্জন চেয়েছে জিতুকে ছবি দেখাতে, কিন্তু জিতু রাজি হয় নি। বলেছে, একবারে সামনা সামনি দেখতে হবে। নাহলে পোষাবে না।
এরমধ্যে একদিন সন্ধ্যাবেলা রঞ্জন আর সন্ধ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। রঞ্জন সন্ধ্যাকে বলছে, “চল বৃষ্টিতে না ভিজে একটা রিকশা নিয়ে রিকশায় করে ঘুড়ি।“
“না। এখন রিকশায় উঠব না।“
“কেন? রিকশায় উঠতে সমস্যা কোথায়?”
“চল না, আরেকটু হেটে আগাই। পরে দেখা যাবে।“
অগত্যা দুজনে হাত ধরাধরি করে হাটতে লাগল। একটু পর সামনে একটা আইস্ক্রিমের ভ্যান এলো। সন্ধ্যা জিজ্ঞেস করল, “আইস্ক্রিম? চলবে তো? একটা চকবার কিনে নাও।“
“একটা কেন?”
“আহা, বেশি কথা বলে। নাও ই না।“
হুট করে মনে পড়ল রঞ্জনের, কালকে শেয়ার করেছিল সন্ধ্যার সাথে যে ওর ইচ্ছে একদিন সন্ধ্যায় রিকশায় বসে দুজনে একটা স্টিক থেকে আইস্ক্রিম শেয়ার করে খাবে। কথাটা মনে পড়তেই খুশি হয়ে উঠল।
টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। একটা খালি রিকশা আসতেই সেটাকে থামালো রঞ্জন। গন্তব্য ভাড়া কিছুই ঠিক না করে উঠে বসল হুড তোলা রিকশায়। নিজের বামপাশে উঠে বসতে দেখলো সন্ধ্যাকে। আড়চোখে তাকালো একবার। পলিথিনের পর্দা সামনে বুক অবধি টেনে নিল যেন বৃষ্টির ফোঁটা ওদের ভিজিয়ে না দেয়। এরপর রিকশাওয়ালাকে বলল, চলুন এবার।
ঠান্ডা বাতাস আসছে। হড়কা পানিতে দুজনেই কিছুটা ভিজে গেছে। হুড তোলা রিকশার ভিতর পর্দার পেছনে আলোআধারীতে সন্ধ্যা কিছুটা চেপে এলো রঞ্জনের দিকে। টের পাচ্ছে রঞ্জনের বাম হাতটা ওর পিঠের পেছন দিয়ে চলে যাচ্ছে। হাতটা ওর কোমড় চেপে ধরল। ওকে কাছে টেনে নিল। সন্ধ্যাও ওর ডান হাতটা রঞ্জনের হাটুর উপর রাখলো। দুজনে দুজনের শরীরের মধ্যে উষ্ণতা বিনিময় করছে। সন্ধ্যা টের পাচ্ছে, রঞ্জন রিকশায় উঠার পর থেকে এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু সন্ধ্যা লজ্জায় তাকাতে পারছে না। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো, রঞ্জনের চোখ ওর হালকা বৃষ্টির পানিতে ভেজা ঠোঁটের দিকে। ঠোঁটের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। রঞ্জন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। সন্ধ্যা হঠাৎ খেয়াল করল, রঞ্জন ওকে আরও মিশিয়ে নিচ্ছে নিজের সাথে। কোমড় জড়িয়ে থাকা হাতটা আরও ঘন করে পেতে চাইছে ওকে। টানছে নিজের দিকে। হাত কোমড় ছাড়িয়ে পেটের দিকে চলে আসছে। এরকম জীবনে এরকম স্বপ্নীল সন্ধ্যা কজনেই বা পায়?
কিন্তু স্বপ্নটা ভেঙে গেল। দুজনই চমকে উঠল একটা শব্দে। রঞ্জনের ফোন বাজছে। বিরক্তি ভরে রঞ্জন ফোনটা রিসিভ করল। দেখল, জিতু ফোন করেছে। জিতু বলছে রঞ্জনকে, “রঞ্জু কোথায় রে তুই এখন?”
“আমি তো ক্যাম্পাসে। তুই কোথায়? কিরে সব ঠিক তো?”
“হ্যা দ্রুত বাড়ি যা, মা তোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ খবর নিয়ে অপেক্ষা করছে। হাতে জরুরী কাজ?”
“না কাজ মানে ঠিক জরুরী না। আচ্ছা কি হয়েছে বল তো?”
“তুই গেলেই বুঝবি”
“আচ্ছা”
ফোন রেখে দিল জিতু। পরিবেশ পালটে গেছে। সেই আবেগঘন নিরবতা এখন আর নেই। একবার শব্দতরঙ্গ প্রবাহিত হওয়া শুরু হলে তা থামানো যায় না। ওরা দুজনের কেউ সে চেষ্টায় গেল না। সন্ধ্যা জিজ্ঞেস করল, “তোমার কাকা?”
“হ্যা কাকা। কি বলল বুঝলাম না। বলল মায়ের সাথে যেন যোগাযোগ করি।“
“তো ফোন করে জেনে নাও।“
“না থাক। পরে জেনে নেব।।“
সন্ধ্যা জানে রঞ্জনের সাথে ওর কাকার সম্পর্ক কেমন এবং ওর কাকা যে ওর কাছে ভগবান সেও জানে। যদিও এই লোকটির নামও এখনও জানে না সে। শুধু জানে কাকা। তাই একটু বিরক্ত হলেও কিছু বলল না। রিকশাওয়ালাকে বলল রিকশা ঘোড়াতে। রঞ্জনকে ওদের পাড়ায় ড্রপ করে দিয়ে যাবে।
রঞ্জন বাড়ি ফিরে জানলো, ওর কাকার বিয়ে করবে ঠিক করেছে। আহ্লাদে আটখানা হয়ে সাথে সাথে জিতুকে ফোন করল। “ তুই বিয়ে করছিস? কবে? কোথায়? মেয়ে কে? প্রেম করছিস জানালি না? এই আমি তোর রঞ্জু? সামনে পেলে গাঁড় ভেঙে দেব।“
“আরে আমার সাথে প্রেম নেই কোনও। আমার বসের মেয়ে। আমাকে বলল। আমি বললাম রাজি। ছবি দেখেছি। বেশ সুন্দরী। তোদের ইউনিভার্সিটিতেই পড়ে। বলল তার মেয়েও নাকি রাজি। তো কথা বলবার নাকি দরকার নেই। আমিও ছবি দেখে এতো পছন্দ করে ফেলেছি, না করতে পারলাম না। দাঁড়া, তোকে ছবি পাঠাই।“
“একদম না, আমি এসে দেখবো সামনা সামনি। তবে তোকে আগেই জানিয়ে রাখি, আমার সন্ধ্যা বেশি সুন্দরী।“
“হাহা, আয়। দেখলেই বুঝবি।“
খুশিতে মনটা ভরে উঠলো ওর। কথাটা সন্ধ্যাকে জানাতে হবে। কিন্তু সন্ধ্যাকে হোয়াটস্যাপ এ অফলাইন দেখাচ্ছে। বাড়ি ফিরেছে ১০ মিনিট আগে টেক্সট করেছিল। ও একটা ছোট্ট মেসেজ দিয়ে রাখলো, “কল করো”। মনের সুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালো রঞ্জ।
দুই সপ্তাহ পর।
রঞ্জন এসেছে জিতুর বিয়ে এটেন্ড করতে। সন্ধ্যার সাথে আর যোগাযোগ করা যায় নি। কোথাও খুজেই পেল না সন্ধ্যা কে। ওর এক বান্ধবী মারফত খবর পেল সন্ধ্যার কোন আত্মীয় নাকি অসুস্থ। তাই দেশের বাইরে গেছে। কিন্তু ফোন কেন করছে না এটাই পরিষ্কার না রঞ্জনের কাছে। যাই হোক। জিতুর বিয়েতে এসে এসব চাপ নিতে ইচ্ছে করছে না। এঞ্জয় করতে থাকলো। অনেক দিন জিতুকে দেখে নি, তার উপর কাকীর সাথে পরিচিত হওয়া। আরিব্বাস…
সাত দিন পর। কালকে চলে যাবে রঞ্জনরা। আজকে ওদের ঘুড়তে বের হবার কথা। পারমিতা, অর্থাৎ রঞ্জনের কাকী, দেখতে রঞ্জনের সন্ধ্যার মতই সুন্দরী। আজকে ওরা সবাই ঘুরতে বের হবে। কিন্তু, রঞ্জন এর বের হবার ইচ্ছে নেই। খুব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। সকালের নাস্তার সময় বলল, “কাকা তোরা সবাই ঘুরে আয়, আমার শরীরটা ভাল নেই। ধকলটা নিতে পারছি না। আমি বরং রেস্ট নেই।“
“হ্যা ঠিক আছে। রেস্ট নে। শরীর কি বেশি খারাপ হল?”
“না এরম কিছু না। ঘুম হয় নি ঠিক মত। ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে।“
“আচ্ছা তাহলে ঘুমা।“
রঞ্জন এবার উঠে ওর মায়ের কাছে গেল। “মা, আমার রুমের গিজারটা কাজ করছে না। কাকাকে বল তো একটু ঠিক করে দিতে।“
“ও মা। আমি কি বলব? তুই বল।“
“আরে কাকা বিয়ে করেছে। তুমি বৌদি হউ, ডাকতে পারো। আমি তো পারি না।“
“আচ্ছা, ছেলে আমার বেশি পেকেছে। এবার তোকেও বিয়ে করাতে হবে, তাই না?”
“হাহাহা।“
আধাঘণ্টা পর, সবাই বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে যাবার আগে জিতু এসে রঞ্জনের ঘরের গিজারের কানেকশন চেক করে দিয়ে গেল। বলল, “এবার আর সমস্যা নেই।“
সবাই বেরিয়ে গেছে। রঞ্জন একা। রঞ্জন স্নানে যাবে। একটা সিগারেট ধরালো। ভালমত সিগারেটটা খেল। চঞ্চল মন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললে মনে আর চাঞ্চল্যটা থাকে না। রঞ্জন এখন সেরকমই শীতল অবস্থায় আছে। ভাল মত শেষ টানটা টেনে নিল সিগারেটের। সিগারেটের বাট এশট্রেতে গুজে, কাকার শেখানো নিয়মে ধোয়ার রিং ছাড়ল বাতাসে।
গোসল খানায় গেল। গিজার এর সুইচ অন করে রেখেছিল মিনিট কুড়ি আগে। জল গরম হয়ে যাবার কথা। ভেতরে নিজের সব পোশাক খুলে নগ্ন হয়ে নিল। একবার নিজের মনে বলে উঠল,”কত কি করার ছিল যে…”
কলের চাবিটা হাত দিয়ে ধরল জলের ফোয়ারা ছাড়বে বলে।
সন্ধ্যার দিকে সবাই বসে আছে জিতুদের ফ্ল্যাটে। পুলিশ এসেছে। ওদের বাথরুমে রঞ্জনের লাশ পাওয়া গেছে। ময়না তদন্ত করার জন্য লাশ নেওয়া হবে হাসপাতালে। কেমন একটা থমথমে পরিবেশ। রঞ্জনের মা বিলাপ বকছেন। জিতু একদম হতভম্ব। সবচেয়ে বেশি মুষরে পরেছে রঞ্জনের কাকী, পারমিতা। পারমিতার দাবী এটা হত্যা। ও নিশ্চিত এটা হত্যা। কারও সাথে কথা বলছে না সে।
দু সপ্তাহ পর।
জিতুর নামে কেস হয়েছে। রঞ্জনকে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করার দায়ে। পারমিতা বাদী হয়ে কেস করেছে।
পারমিতার বক্তব্যঃ আমি আর কেউ নই, আমি রঞ্জনের প্রাক্তন প্রেমিকা সন্ধ্যা। এটি আমার ডাকনাম। ভাল নাম পারমিতা বক্সি। বাবা জোড় করে আমাকে বিয়ে দিয়ে দেন আমার মতামত ছাড়াই। আমি রঞ্জনের থেকে বিদায় ও নিয়ে যেতে পারি নি। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমার বাবার পছন্দ করা বর আর কেউ নয়, রঞ্জনের বন্ধুসমতুল্য কাকা, জিতু। এটা অবশ্য আমরা কেউ ই জানতাম না। কিন্তু বিষয়টা আবিষ্কার হয় বিয়ের দিন। আমি রঞ্জনকে দেখে চমকে উঠি। কিন্তু আমরা দুজনেই ম্যাচিওর আচরণ করি। আমরা পরে নিজেরা সিদ্ধান্ত নিই যে জিতুকে এটা কোনও অবস্থাতেই জানতে দেওয়া যাবে না। আমরা চেপে যাব বিষয়টা। কিন্তু আমি ভালবাসতাম রঞ্জনকে। জিতু আমার কাছে আসতে চাইছিল, যেহেতু আমি ওর স্ত্রী। কিন্তু আমি রাজী ছিলাম না। তাই ওর কাছে সময় চেয়েছিলাম। কিন্তু জিতু অপেক্ষা করতে রাজি ছিল না। এর মধ্যে কোনও এক ভাবে জেনে যায় জিতু যে আমার পূর্বে সম্পর্ক ছিল। তাই ও আমাকে রঞ্জন খুন হবার আগের রাতে এই কথা তুলে এবং প্রাক্তনের খবর জানতে চায়। আমি অস্বীকার করি। পরে ও আমার কাছে আসতে চাইলে আমি আরও সময় চাই। এক পর্যায়ে জিতু আমাকে ধর্ষণ করে। পরে হয়তো কোনও ভাবে জেনে গেছিল যে আমার প্রাক্তন আর কেউ নয়, রঞ্জন। তখন রঞ্জনকে হত্যা করে।
জিতুর বক্তব্যঃ আমি জানতাম না পারমিতা আর সন্ধ্যা অভিন্ন। জানলে আমি কখনও বিয়ে করতাম না। রঞ্জন আমার কলিজার টুকরা। আমি রঞ্জনকে কষ্ট দিতে চাই নি। কেউ একজন আমাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানায় পারমিতার অনেক ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে কারও সাথে। কিন্তু আমি এটা জানতাম না সেটা কে। হ্যা আমি রিপুর তাড়নায় ধৈর্য্য ধরতে পারি নি। জোড় করে নিয়েছিলাম পারমিতাকে। কিন্তু আমি রঞ্জনকে হত্যা করি নি।
হত্যার প্রমাণঃ রঞ্জন হত্যার দিন, সবার ঘুরতে যাবার কথা ছিল। রঞ্জন অসুস্থ ছিল বলে যায় নি। কিন্তু রঞ্জনের রুমের স্নানঘরের গিজার নষ্ট ছিল। সেটা ঠিক করবার জন্য রঞ্জন ওর মায়ের মারফত জিতুকে বলে। জিতু হিংসার বশবর্তী হয়ে ঠিক করবার সময় গিজারের কলের সাথে শর্টসার্কিট করে দেয়। জিতু যে এই কাজে ওস্তাদ ও সর্বশেষ জিতুই ঐটার সার্কিটে হাত দিয়েছিল তার সাক্ষী আছে। পরে এক্সপার্টরা দেখেছে যে শর্ট সার্কিট ইচ্ছাকৃত। এটা দুর্ঘটনা নয়। যেহেতু রঞ্জন বলেছে গিজার ঠিক করাতে, এবং পরের দিন ওরা চলে যেত। তাই রঞ্জন ওটা ব্যবহার করতই। এভাবে রঞ্জন তরিৎপৃষ্ট হয়ে মারা যায়। এটি একটি মার্ডার।
ব্যবচ্ছেদঃ রঞ্জন বিয়ের অনুষ্ঠানে পারমিতাকে দেখেই বুঝল কেস বিরাট। এটা সন্ধ্যা। কিন্তু এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। সন্ধ্যাকে চোখে ইশারা করল কথা বলতে চায়। ওরা ব্যক্তিগতভাবে কথা বলে জানল, সন্ধ্যার বাবার চাপাচাপিতে এই ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এখন আর এটা জিতুকে জানানো যাবে না। রঞ্জন বিদেশে চলে যাবে। ওরা থাকুক এখানে। সন্ধ্যা কিছুদিন পর ভুলে যাবে রঞ্জনকে। কিন্তু এর মধ্যে সন্ধ্যার পেছনে ঘুরতে থাকা কোনও এবিউজার জিতুকে জানায় সন্ধ্যার ব্যাপারে। জিতু সন্ধ্যাকে ধর্ষণ করে। এই খবর জিতু আবার নিজেই গিয়ে সেদিন রাতেই রঞ্জনকে জানায়। যেহেতু দুজনই একে অপরের কাছে কিছুই লুকাতো না। রঞ্জন বিষয়টায় মনে খুব আঘাত পায়। কিন্তু ওর কিচ্ছু করার নেই। ও ওর কাকাকে কিছু বলতেও পারবে না। সন্ধ্যাকে বাঁচাতেও পারবে না। জানে সন্ধ্যা কোনও স্টেপ নেবে না। তাই সারারাত বসে ও একটা প্লান বানায়। রাতে নিজেই স্নানঘরের গিজার নষ্ট করে। পরের দিন মা কে দিয়ে কাকাকে বলিয়ে সেটা সারায়। এরপর সবাই বেরিয়ে গেলে নিজে সেটাতে একটা শর্ট সার্কিট ক্রিয়েট করে। এরপর জেনে বুঝে তড়িতায়িত অবস্থায় থাকা কলের চাবিতে হাত দেয়। তরিতাহিত হয়ে রঞ্জনের মৃত্যু হয়। যা মূলত আত্মহত্যা। কিন্তু সে জানে এবার মুখ খুলবে সন্ধ্যা অর্থাৎ পারমিতা। ফলাফলে জিতুর থেকে আলাদা হয়ে যেতে চাইবে। কারণ সে ভাববে জিতু খুন করেছে রঞ্জনকে। প্রতিটা এভিডেন্স ও সেভাবেই সাজানো। কারণ এভাবে কেউ আত্মহত্যা করবে না। আর রঞ্জনযে এসব কাজ জানে এটা কেউ ভাবতেই পারবে না। রঞ্জন তাই এই প্লানটা করে। নিজের কষ্ট থেকে মুক্তি, সন্ধ্যার মুক্তি, জিতুর শাস্তি বা আলাদা করা, যাই হোক।
তড়িতাহিত অবস্থায় থাকা কলে হাত দেবার পূর্বে রঞ্জন বলছিল নিজেকে, কাকা তুই বললে তো আমি সব করতে পারতাম। কিন্তু ধর্ষণ করাটা তোর উচিৎ হয় নি। হোক না তোর নিজের বিয়ে করা বউ। সম্মতিটা দরকারি।
রঞ্জনের সুইসাইড নোটঃ
“তোকেও ভালবাসি, কাকা। তোমাকেও, সন্ধ্যা। কিন্তু উপায় নেই আমার। আমি আর পারছি না নিতে। তাই আত্মহত্যা করে সেটাকে খুন সাজিয়ে রেখে গেলাম। কাকার জন্য আমি সব করব। কিন্তু পারমিতার কষ্ট আমি নিতে পারব না। ধর্ষণ করাটা উচিৎ হয় নি। কিন্তু এটা কেউ জানবে না।“
এরপর সেটা সিগারেট ফুকতে ফুকতে পুড়িয়ে ছাইদানিতে ফেলে দেয়।
এখন ৮ বছর পর প্যারলে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে জিতু বড্ড একা। কোথাও তার কেউ নেই। কিন্তু সে যে নির্দোষ। তার রঞ্জনকে সে খুন করে নি।
দীর্ঘ আটটি বছর। কত দ্রুত কেটে গেল দীর্ঘ আটটি বছর। তখন ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে বেরিয়েছে কেবল জিতু। কয়েকমাস হল ভাল একটা চাকরিও পেয়ে গেছিল। ফ্রেশার হিসেবে ভালই মাইনা পেত। সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছিল জিতুর সামনে, সবাই তাই বলতো। অন্তত জিতু নিজে সেটুকু বিশ্বাস করতোই। কিন্তু ভবিষ্যৎ যে কেবল সময়ের মধ্যেই থাকে। কেবল সময়ই যে জানে যে ভবিষ্যতে কি লেখা রয়েছে। এই লেখা প্রাচীণ কোনোও ভাষার চাইতেও দুর্বোধ্য। বুঝতে হলে সেই সময়কালে উপস্থিত হওয়া চাই। নাহলে এর অর্থ বোঝা যায় না।
রাস্তায় একটু আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে। রাস্তা হালকা কাদা কাদা। এদিকে সেদিকে ময়লা পানি জমে আছে। হাটতে গেলে পায়ের জুতার তলায় বাড়ি খেয়ে কিছু নোংরা পানি উঠে প্যান্টের পেছনটায় লাগছে। মনে মনে হাসল জিতু। সময় যায়, মানুষের কিছু বৈশিষ্ট্য বদলে যায় না। প্রথমে মায়ের কাছে, এরপর বৌদির কাছে কত বকা শুনেছে একসময় এই নিয়ে জিতু। প্যান্টের পেছনের অংশটুকু নোংরা হত বৃষ্টির মৌসুমে হড়কা পানিতে লেগে। সেই কথাই স্মরণ করল জিতু। খুব বকত মা, এরপর বৌদি।
একটু নিরিবিলি জায়গায় এসে একটা চায়ের দোকান দেখে সেদিকে এগিয়ে গেল জিতু। চায়ের দোকানে বসল। আশেপাশে তেমন কোনও উত্তেজনা নেই। অথচ ওর কাছে সব নতুন লাগছে। এমনকি একটা সামান্য চায়ের দোকানে বসাটাও নতুন লাগছে। দোকানদারের দিকে ফিরে বলল, “দাদা একটা চা দিন তো, ভাড়ে। দুধ দিয়ে, চিনি ছাড়া।“
“বসুন, দিচ্ছি। আর কিছু লাগবে দাদা?” চা ওয়ালা বলল।
“হ্যা একটা সিগারেট ছাড়ুন।“
দোকানদার একটি সিগারেটের শলাকা বের করে দিল জিতুকে। হাতে নিয়ে সিগারেটটির দিকে এক পলক তাকিয়ে রইল। দুই ঠোঁটের ফাঁকে কামড়ে ধরল সিগারেটের ফিল্টার। চায়ের দোকানে ঝুলতে থাকা লাইটারটা ডান হাতে ধরে বাম হাতের আড়ালে শিখা জ্বালিয়ে সিগারেটটা টান দিয়ে এক বুক ধোঁয়া টেনে ধোঁয়াটা বাতাসে ভাসালো জিতু। বাতাস ঘোলা করে তুললো সেই ধোঁয়া। চোখগুলোও কি একটু ঘোলাটে হয়ে উঠলো? দৃষ্টিও কি একটু ঝাপসা হয়ে এলো? ঘা শুকিয়ে যায় কিন্তু দাগ থেকে যায়।
বসে বসে সিগারেটটিকে ছাই এ পরিণত করতে লাগল আর স্মৃতিচারণ করতে লাগল জিতু। অর্ধেক অবধি শেষ করে ভাবতে লাগল জিতু, “এইযে অর্ধেক সিগারেট, এই অংশটুকু তো তোর ভাগের, রঞ্জন। কে শেষ করবে এটুকু?” কোথায় আজকে রঞ্জন? কোথায় আজকে সন্ধ্যা? কিচ্ছু জানা নেই জিতু।
জীবন একটি রোলারকোস্টার। জীবনের প্রায় সাড়ে তিন দশক পার করে এসে এটা এইবার হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে জিতু। কোথাকার জীবন কোথা থেকে মুহূর্তের মধ্যে কোথায় টেনে নিয়ে আসে। সিগারেটটা শেষ করে চায়ের দোকানে খুচরো কিছু পয়সা দিয়ে বিল মিটিয়ে দিল জিতু। কিন্তু দোকান থেকে উঠে গেল না। এখানে বসে বসে ভাবতে ভালই লাগছে ওর।
জিতুরা ছিল ৪ ভাই ৪ বোন। জিতুই সবার ছোট। জিতুর বড় দাদার সাথে জিতুর বয়সের পার্থক্য অনেক। তাই বড় বৌদিও জিতুর কাছে তার মায়ের মতই ছিল। জিতু যখন প্রাইমারিতে সবে ভর্তি হবে তখনই জিতুর মা মারা যান। এরপর মা বলতে জিতু বড় বৌদিকেই বুঝত। জিতুর বড় বৌদির একটাই ছেলে, রঞ্জন। জিতুর চাইতে বছর তিনেক ছোট। সম্পর্কে কাকা ভাইপো হলেও দুজনের বয়স পিঠাপিঠি হওয়ায় একদম মানিকজোড় ছিল। জিতু তার বড়দাদা অর্থাৎ রঞ্জনের বাবা মায়ের কাছেই বড় হয়েছে। রঞ্জন সবসময়ই একটু চুপচাপ স্বভাবের ছিল। অন্যদিকে জিতু বরাবরই প্রাণবন্ত, চঞ্চল। যেকোনও কাজেই জিতু পারদর্শী। তাই সবাই রঞ্জনের চাইতে জিতুকে একটু বেশি পছন্দ করত। কিন্তু এই ব্যাপারটা কখনও রঞ্জনের মনে হিংসা-বিদ্বেষ এর জন্ম দেয় নি।
দুজনের মধ্যে কখনও কোনও ক্লেশ ছিল না। একজন বয়সে বড় হলেও আরেকজনের উপর কোনও খবরদারি বা শাসন করত না। কেমন যেন একটা বোঝাপড়া ছিল দুজনের মধ্যেই। ওদের দুজনকে কেউ কখনও লড়াই বিবাদ করতে দেখে নি। অদ্ভুত মিল ছিল দুজনের মধ্যেই। অনেকটা ক্রাইম পার্টনার এর মত সম্পর্কই বেশি প্রতীয়মান হত দুজনের মধ্যে, কাকা ভাতিজার সম্পর্ককে ছাপিয়ে।
দুজনের মধ্যে মিলটা এতোই বেশি ছিল যে, রঞ্জনের মাধ্যমিকের মূল্যায়ন পরীক্ষা খারাপ হবার পর সারারাত দুজনে মিলে সিগারেট ফুঁকেছিল। এমনকি রঞ্জনের মদ্যপ্রাসন ও জিতুর সাথেই। যেখানে রঞ্জন আটকে যেত সেখানে জিতু সামলে নিত। আবার যেখানে জিতুর বিপদ ছিল সেখানে রঞ্জন কাজে আসত। তারা দুজনই দুজনের সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিল। রঞ্জনের মা সবসময় বলত, “রঞ্জু আর জিতু বোবা হলেও একে অপরের সাথে কথা বলে যেতে পারবে সারাক্ষণ।“
সত্যিই তাই। দুজনের টিউনিং এরকম ই ছিল। কখনও এরম হয় নি যে এরা একজন আরেকজনের সাথে নিজেদের ব্যাপারের কোনও কথা গোপন রেখেছে। কাকা ভাতিজা দুজনের কাছে দুজন যেন খোলা বই ছিল। অন্ধকারেও একে অন্যকে পড়তে পারত।
জিতু চায়ের দোকানে বসে বসে আরেকটা সিগারেট ধরালো। রঞ্জনের কথা খুব মনে পড়ছে। রঞ্জনকে সে কতটাই না ভালবাসত। স্কুলে থাকতে একবার ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে কিছু ছেলে রঞ্জনকে চড় মেরেছিল। খবর পেয়ে জিতু ছুটে গিয়েছিল ফুটবল খেলার মাঠে। রাগে দুঃখে তখন জিতুর শরীর কাপছে আর চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। একাই গিয়ে সবগুলো ছেলের উপর চড়াও হয়েছিল সেদিন জিতু। নিজেও বেধরক মার খেয়েছিল। তবুও লড়ে গেছিল রঞ্জনের জন্য।
রঞ্জনকে নিজের জীবনের চাইতেও বেশি ভালবাসত জিতু। এখনও ভালবাসে। কিন্তু সেই রঞ্জন আজকে কোথায়? কোথায় আছে রঞ্জন? কোথায় গেলে পাবে সে রঞ্জনকে? কি করে এই ঘটনাটি ঘটল জানে না জিতু। রঞ্জনকে ফিরে পাবার জন্য জীবন থেকে আরও আটটি বছর দিয়ে দিতে রাজি আছে জিতু। যদি এতে রঞ্জনকে আবার পাওয়া যায়, তাহলে তার এতে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু সব চাওয়া বিধাতা সব সময় পূরণ করেন না।
রঞ্জন আর জিতু একই স্কুল কলেজে পড়েছে। কলেজ শেষে জিতু সিদ্ধান্ত নিল সে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হবে। জিতুর প্রথম থেকেই পছন্দ ছিল সাহিত্য। সে কাকাকে প্রতিটা ক্ষেত্রে ফলো করলেও এই দফা সে নিজের ইচ্ছে মত পথে হাটল। শহরের বাইরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে গেল জিতু। রঞ্জন তখনও উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষা দেয় নি। নিয়মিত তাদের দুজনের মধ্যে ফোনে কথা হত। সেখানের আবহাওয়া কেমন, বন্ধুবান্ধব কেমন, মেয়েরা কেমন দেখতে, কোনও বান্ধবী জুটিয়েছে কি না এধরনের নানা রকম কথোপকথন চলতেই থাকতো দুজনের মধ্যে। জিতুও নানা রকম তথ্য দিয়ে এবং রসিয়ে গল্প বলে উৎসাহিত করত রঞ্জনকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য। কিন্তু রঞ্জন সেসব শুনে পুলকিত হলেও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বার ইচ্ছা তার মধ্যে কখনও জন্মায় নি।
রঞ্জন নিজের মত করে বড় হতে থাকে। কাকা তার রোলমডেল। কিন্তু কাকার সাথে তার মিল বলতে গেলে প্রায় নেয় ই। কিন্তু সম্পর্কটা রক্ত ছাড়িয়ে আত্মায় পৌঁছে গেছে।
এরম করেই হাওয়ায় দিন ভেসে যেতে থাকে দুজনের। জিতুর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া এগিয়ে চলছে। রঞ্জন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মাঝে বছরে দুবার করে বাড়িতে এসে বেড়িয়ে গেছে জিতু। এর মধ্যে জিতুর নতুন আরেকটি গুণ সবার কাছে প্রকাশিত হয়েছে। জিতু আগের থেকেই মেশিন পত্রের ব্যাপারে ওস্তাদ ছিল। এখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়ে হাতেকলমে বহু জিনিস ব্যবহার করে ওদের কমপ্লেক্সের ইঞ্জিনিয়ার বনে গেছে। জিতু ছুটিতে বাড়ি এলে বিশাল একটা সময় ব্যয় করে নিজেদের এবং এর ওর বাড়ির বিভিন্ন মেশিনের ত্রুটি সারাতে। ইলেক্ট্রিসিটির সকল কাজে সে ওস্তাদ। ফলাফলে সবার জিতুর প্রতি আগ্রহ আগের চাইতে আরও বেড়ে যাচ্ছিল।
ব্যাপারটাকে জিতু সবসময় রঞ্জনের কাছে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করত। রঞ্জনও খুব গর্ববোধ করত তার কাকাকে নিয়ে। রঞ্জন সবসময় মনে প্রাণে বিশ্বাস করত তার কাকা এই পৃথিবীর সেরা মানুষটির একটি। সেই বিশ্বাসের আগুনে অন্যদের থেকে জ্বালানী এলে রঞ্জনের বুকটা গর্বে আধ হাত ফুলে উঠত বৈ কি।
এরমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় এলো। রঞ্জন ওর কাকা কে বলল, “কাকা, তোর সাথে কথা বলবার ছিল যে আমার।“
“তোর আমার সাথে আবার কথা বলবার দরকার হল কবে থেকে রে?”
“এরম করে বলছিস কেন? আমরা কি কথা বলি না?”
“বলি। তবে সেটা সময় কাটাতে। মনের ইচ্ছে জানানোর জন্য না। সেটা আমরা এমনিই বুঝতে পারি, তাই নারে? আমি জানি তুই কি বলতে চাস। তুই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাইছিস না, তাই তো?”
“হ্যা কাকা। আমার ভাল লাগে না এসব। আমার সাহিত্য ভাল লাগে, তুই তো জানিস ই।“
“লেহ, হয়ে গেল। সাহিত্যই পড়। এ আর এমন কি? দেখ রঞ্জু, কি পড়ছিস সেটার চেয়েও জরুরী হচ্ছে পড়ছিস কি না। প্রোগ্রেসটাই আসল। আর কিচ্ছু না। তুই একদম কিচ্ছুটি চিন্তা করিস না। আমি বড়দা আর বৌদির সাথে কথা বলে নেব। সব ম্যানেজ করে নেব। কিচ্ছু চিন্তা করিস না তুই। কিন্তু একটা শর্ত আছে কিন্তু।“
“কি শর্ত?” একটু ঘাবড়ে গেল রঞ্জন শর্তের কথা শুনে।
“এই তেমন কিছুই না। তোকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হতে হবে। আমি জানি আমার রঞ্জু এটা পারবে। পারবি না রে?”
“তুমি বললে কাকা আমি ছাদ থেকে লাফ ও দিতে পারি।“
হেসে উঠল জিতু, জানে সে। রঞ্জন ওর জন্য সব করতে পারে।
রঞ্জন শহরের মধ্যেই একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেল বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করতে। বছর খানেক যেতে না যেতেই পরীক্ষা এসে কড়া নারল সামনে। বলা বাহুল্য, রঞ্জন টপ করে প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষতে প্রোমশন পেল। এরমধ্যে জিতুর গ্রাজুয়েশন শেষ হয়ে গেছে। ইন্টার্ন করবার জন্য একটা কম্পানিতে ইন্টার্নশীপ করতে জিতুও ঘরে ফিরে এসেছে।
রঞ্জনের খুশি এবার দেখে কে। এবার কাকা তার কাছে থাকবে। কত রকমের কথা বলা লাগে কাকার সাথে। অতো কথা ফোনে বলা যায় নাকি? রোজ ক্লাস সারাদিন, ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ানোর চেষ্টা, এর ওর সাথে ইন্ট্রোভার্ট রঞ্জনের মেশার আকাঙ্ক্ষা আর রাতে অফিস ফেরত কাকার সাথে ঘরে বসে সিগারেট ফোঁকা আর ধুন্দুমার আড্ডা, উইকেন্ডে মদ গেলা। এই চলছিল দুজনের জীবনে। জিতু তিনমাসের ইন্টার্ন সেরে সেই কম্পানিতেই একটা মোটা বেতনের চাকরি পেয়ে গেল। খুব একটা সহজ বিষয় না এটা। বেশ বিরল ঘটনাই। কিন্তু কপালে থাকলে ঠেকায় কে? তাই হয়েই গেল।
যেদিন জিতুর চাকরি কনফার্ম হয় সেদিন রঞ্জনের ক্যাম্পাসে একটা অনুষ্ঠান ছিল। সেই অনুষ্ঠানে রঞ্জনের রচনা করা একটি নাটক মঞ্চস্থ করা হয়। রঞ্জন শুধু চিত্রনাট্য আর স্ক্রিপ্ট লিখেছিল। সাধারণত এসব অনুষ্ঠান রঞ্জন এরিয়ে চলে। কিন্তু সে আস্তে আস্তে বুঝল, এসব অনুষ্ঠানে না গেলে তার জ্ঞান থেকে যাবে সীমিতই। তাই সেও অনুষ্ঠানে দর্শক হিসেবে অংশ নিল।
অনুষ্ঠানে রঞ্জনের আরও আগ্রহের কারণ হল, তার লেখা নাটকটা মঞ্চে কেমন লাগে সেটা দেখা। পাশাপাশি স্ক্রিপ্টটাও তো শুনতে হবে। ট্রাজিক রোমান্টিক ঘরানার একটি নাটকের সংলাপ লিখতে গিয়ে রঞ্জনের গাঁড় ফেটে গেছে।
একদম প্রথম সাড়িতেই বসল রঞ্জন। অনুষ্ঠান শুরু হতে এখনও বাকি। বিরক্তই লাগা শুরু হল রঞ্জনের। কিন্তু অনুষ্টান শুরু হতে রঞ্জনের মনোযোগ যে একবার স্টেজের দিকে গেল, আর সরলই না। রঞ্জন জানেই না পুরোটা অনুষ্ঠানের সময় ধরে মঞ্চে কি চলেছে। তার নজর শুধু আটকে আছে মঞ্চের উপর থাকা উপস্থাপিকার দিকে।
লাল পেড়ে সাদা শাড়ী পড়া কাধ অবধি ঢেউ খেলানো চুলের ফরসা সেই সাদাসিধে মেয়েটাকে তার অপূর্ব সুন্দরী মনে হচ্ছে। গলায় সাদা মুক্তার মালাটার উপর থেকে চোখ ই সরাতে পারছে না রঞ্জন। কি এক অদ্ভুত মোহে পড়ে গেছে যেন। মাথায় এলোমেলো কবিতা, উক্তি ঘুড়ে বেড়াতে শুরু করল ওর।
কবিতা লেখার লোক রঞ্জন না। কিন্তু কেমন যেন অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে রঞ্জনের সাথে। এই ধরনের অনুভূতির সাথে ইন্ট্রোভার্ট রঞ্জন একদমই পরিচিত নয়।
এক পর্যায়ে রঞ্জনের মনে হচ্ছিল এক্ষুনই হয়তো সে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মরে যাবে। যখন নাটকটা মঞ্চস্থ হতে যাচ্ছিল তখন সেই নাটকের রচয়িতা ও সংলাপ রচয়িতার নাম যখন পড়ল সেই সুন্দরী উপস্থাপিকা, রঞ্জনের মনে হচ্ছিল, এরকম কিছুর কাছে যেন সম্পূর্ণ জগতসংসার তুচ্ছ। একেকটি পরিবেশনার চাইতে উপস্থাপনার দিকেই রঞ্জনের মনোযোগ ছিল বেশি। কে তাকে বলেছিল চুলে রজনীগন্ধ্যার মালাটা আটকে নিতে? লাল টিপটারই বা কি দরকার ছিল? কানের অমন দুলগুলো কেন বারবার কাধের উপর এসে পড়া খোলা চুলের মাঝে ঝিকিয়ে উঠতে হবে?
গেল তো এবার কানের ঐ দুলে প্রাণ বিদ্ধ হয়ে?
এটাকে ক্রাশ বলে না প্রেম বলে না কি বলে, জানে না রঞ্জন। শুধু জানে ডুবে গেছে পুরো। কতক্ষণে কাকার সাথে দেখা করবে, এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবে এসব ভেবে চলেছে রঞ্জন। আবার অনুষ্ঠানটা সাময়িক, একটু পর শেষ হলেই মেয়েটিও হারিয়ে যাবে ভেবেও খারাপ লাগছে তার কাছে।
অনুষ্ঠান শেষে সেদিন অনেক দেরি করে বাড়ি ফিরল রঞ্জন। দেরি করে মূলত ফিরতে চায় নি। কিন্তু ক্লাসমেটদের সাথে থেকে দেরি হয়ে গেল। বাড়ী ফিরে দেখল, বাড়িতে কেমন একটা উৎসব উৎসব পরিবেশ রয়েছে। জানা গেল, জিতুর চাকরি কনফার্ম হয়েছে। রঞ্জনের খুশি আর দেখে কে। সেদিন রাতে জিতু ওদের সবাইকে বাইরে খাওয়াতে নিয়ে গেল। দীননাথ সেন রোডের শাহী বিরিয়ানি ওদের সবারই খুব প্রিয়।
ওর সাথে সারাদিন কাকার কথা বলবার সুযোগ হয় নি। ঘরে ফিরে চেঞ্জ করেই ছুটলো কাকার রুমে রঞ্জন। জিতুর রুমের দরজা ভেজানো। নক না করেই জিতুর রুমে ঢুকে গেল। জিতু দরজা খোলার শব্দে চমকে উঠল। জিজ্ঞেস করল, “কিরে, সিগারেট নেই?”
“থাকলেই বা কি। আমরা ভাগাভাগি করে সিগারেট খাই না?”
“হ্যা, আয়। আজকে এত্তো সুন্দর একটা দিন গেল আমার জন্য।“
“জানি। কাকা জানিস আমার দিনটাও আজকে অনেক সুন্দর গেছে।“
“হ্যা সে তো তোর চোখে মুখে চাপা উত্তেজনা থেকেই বুঝতে পারছি বেশ। কেস টা কি বলতো?”
“কাকা তোর ভাইপো প্রেমে পড়েছে রে।“
“হ্যাহ? বলিস কিরে? কে সেটা শুনি? কোথায় পেলি?”
“আরে কাকা সব বলব। এতো কিছু একসাথে জিজ্ঞেস করে নাকি।“
“নামটা তো বল।“
“সন্ধ্যা।“
এরপর রঞ্জন সব বলল। বলল, অনুষ্ঠানের শেষে ওর ক্লাসমেটরা ওকে ডেকেছিল ব্যাকস্টেজে। সেখানে ঐ মেয়েটা ওর সাথে কথা বলেছে। পরিচিত হয়েছে ও মেয়েটার সাথে। মেয়েটা সঙ্গীত বিভাগে পড়াশোনা করছে বর্ষে। কোনও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা যুক্ত হয় নি তবে ফোন নম্বর আদান প্রদান হয়েছে। হোয়াটসএপ এ কথা হবে বলেছে।
“ছবি আছে? হোয়াটসএপ ডীপি?” জিতু জানতে চাইল।
“না কোনও ডীপি দেওয়া নেই।“
“যাই হোক, রঞ্জু। জেনে খুব ভাল লাগল। দেখা করাবি কবে কাকার সাথে?”
“কাকা, বালের কথা বলিস না। নিজেই চিনি না এখনও। তোকে দেখা করাবো কি?”
“হাহাহা, আচ্ছা। কথা টথা বলে নে। পরে জানাস আমাকে।“
“সিগারেটের বাকি অর্ধেকটা দেবে তুমি বাঁড়া? নাকি একাই শেষ করবে?”
ঐ ঘটনার পর আরও বছর দুই কেটে গেল। এর মাঝে সন্ধ্যার সাথে রঞ্জনের সম্পর্ক অনেক দূর এগিয়ে গেছে। রীতিমত প্রেম করছে ওরা দুজন। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হল এইখানে যে, চাকরিটা হয়ে যাওয়ার কারণে সপ্তাহখানেকের মধ্যেই জিতুকে শহরের বাইরে চলে যেতে হয়। তাই জিতুর সাথে রঞ্জন চাইতেও সন্ধ্যার দেখা করাতে পারে নি। জিতুর সাথে বহুবার কথা হবার সময় রঞ্জন চেয়েছে জিতুকে ছবি দেখাতে, কিন্তু জিতু রাজি হয় নি। বলেছে, একবারে সামনা সামনি দেখতে হবে। নাহলে পোষাবে না।
এরমধ্যে একদিন সন্ধ্যাবেলা রঞ্জন আর সন্ধ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। রঞ্জন সন্ধ্যাকে বলছে, “চল বৃষ্টিতে না ভিজে একটা রিকশা নিয়ে রিকশায় করে ঘুড়ি।“
“না। এখন রিকশায় উঠব না।“
“কেন? রিকশায় উঠতে সমস্যা কোথায়?”
“চল না, আরেকটু হেটে আগাই। পরে দেখা যাবে।“
অগত্যা দুজনে হাত ধরাধরি করে হাটতে লাগল। একটু পর সামনে একটা আইস্ক্রিমের ভ্যান এলো। সন্ধ্যা জিজ্ঞেস করল, “আইস্ক্রিম? চলবে তো? একটা চকবার কিনে নাও।“
“একটা কেন?”
“আহা, বেশি কথা বলে। নাও ই না।“
হুট করে মনে পড়ল রঞ্জনের, কালকে শেয়ার করেছিল সন্ধ্যার সাথে যে ওর ইচ্ছে একদিন সন্ধ্যায় রিকশায় বসে দুজনে একটা স্টিক থেকে আইস্ক্রিম শেয়ার করে খাবে। কথাটা মনে পড়তেই খুশি হয়ে উঠল।
টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। একটা খালি রিকশা আসতেই সেটাকে থামালো রঞ্জন। গন্তব্য ভাড়া কিছুই ঠিক না করে উঠে বসল হুড তোলা রিকশায়। নিজের বামপাশে উঠে বসতে দেখলো সন্ধ্যাকে। আড়চোখে তাকালো একবার। পলিথিনের পর্দা সামনে বুক অবধি টেনে নিল যেন বৃষ্টির ফোঁটা ওদের ভিজিয়ে না দেয়। এরপর রিকশাওয়ালাকে বলল, চলুন এবার।
ঠান্ডা বাতাস আসছে। হড়কা পানিতে দুজনেই কিছুটা ভিজে গেছে। হুড তোলা রিকশার ভিতর পর্দার পেছনে আলোআধারীতে সন্ধ্যা কিছুটা চেপে এলো রঞ্জনের দিকে। টের পাচ্ছে রঞ্জনের বাম হাতটা ওর পিঠের পেছন দিয়ে চলে যাচ্ছে। হাতটা ওর কোমড় চেপে ধরল। ওকে কাছে টেনে নিল। সন্ধ্যাও ওর ডান হাতটা রঞ্জনের হাটুর উপর রাখলো। দুজনে দুজনের শরীরের মধ্যে উষ্ণতা বিনিময় করছে। সন্ধ্যা টের পাচ্ছে, রঞ্জন রিকশায় উঠার পর থেকে এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু সন্ধ্যা লজ্জায় তাকাতে পারছে না। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো, রঞ্জনের চোখ ওর হালকা বৃষ্টির পানিতে ভেজা ঠোঁটের দিকে। ঠোঁটের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। রঞ্জন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। সন্ধ্যা হঠাৎ খেয়াল করল, রঞ্জন ওকে আরও মিশিয়ে নিচ্ছে নিজের সাথে। কোমড় জড়িয়ে থাকা হাতটা আরও ঘন করে পেতে চাইছে ওকে। টানছে নিজের দিকে। হাত কোমড় ছাড়িয়ে পেটের দিকে চলে আসছে। এরকম জীবনে এরকম স্বপ্নীল সন্ধ্যা কজনেই বা পায়?
কিন্তু স্বপ্নটা ভেঙে গেল। দুজনই চমকে উঠল একটা শব্দে। রঞ্জনের ফোন বাজছে। বিরক্তি ভরে রঞ্জন ফোনটা রিসিভ করল। দেখল, জিতু ফোন করেছে। জিতু বলছে রঞ্জনকে, “রঞ্জু কোথায় রে তুই এখন?”
“আমি তো ক্যাম্পাসে। তুই কোথায়? কিরে সব ঠিক তো?”
“হ্যা দ্রুত বাড়ি যা, মা তোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ খবর নিয়ে অপেক্ষা করছে। হাতে জরুরী কাজ?”
“না কাজ মানে ঠিক জরুরী না। আচ্ছা কি হয়েছে বল তো?”
“তুই গেলেই বুঝবি”
“আচ্ছা”
ফোন রেখে দিল জিতু। পরিবেশ পালটে গেছে। সেই আবেগঘন নিরবতা এখন আর নেই। একবার শব্দতরঙ্গ প্রবাহিত হওয়া শুরু হলে তা থামানো যায় না। ওরা দুজনের কেউ সে চেষ্টায় গেল না। সন্ধ্যা জিজ্ঞেস করল, “তোমার কাকা?”
“হ্যা কাকা। কি বলল বুঝলাম না। বলল মায়ের সাথে যেন যোগাযোগ করি।“
“তো ফোন করে জেনে নাও।“
“না থাক। পরে জেনে নেব।।“
সন্ধ্যা জানে রঞ্জনের সাথে ওর কাকার সম্পর্ক কেমন এবং ওর কাকা যে ওর কাছে ভগবান সেও জানে। যদিও এই লোকটির নামও এখনও জানে না সে। শুধু জানে কাকা। তাই একটু বিরক্ত হলেও কিছু বলল না। রিকশাওয়ালাকে বলল রিকশা ঘোড়াতে। রঞ্জনকে ওদের পাড়ায় ড্রপ করে দিয়ে যাবে।
রঞ্জন বাড়ি ফিরে জানলো, ওর কাকার বিয়ে করবে ঠিক করেছে। আহ্লাদে আটখানা হয়ে সাথে সাথে জিতুকে ফোন করল। “ তুই বিয়ে করছিস? কবে? কোথায়? মেয়ে কে? প্রেম করছিস জানালি না? এই আমি তোর রঞ্জু? সামনে পেলে গাঁড় ভেঙে দেব।“
“আরে আমার সাথে প্রেম নেই কোনও। আমার বসের মেয়ে। আমাকে বলল। আমি বললাম রাজি। ছবি দেখেছি। বেশ সুন্দরী। তোদের ইউনিভার্সিটিতেই পড়ে। বলল তার মেয়েও নাকি রাজি। তো কথা বলবার নাকি দরকার নেই। আমিও ছবি দেখে এতো পছন্দ করে ফেলেছি, না করতে পারলাম না। দাঁড়া, তোকে ছবি পাঠাই।“
“একদম না, আমি এসে দেখবো সামনা সামনি। তবে তোকে আগেই জানিয়ে রাখি, আমার সন্ধ্যা বেশি সুন্দরী।“
“হাহা, আয়। দেখলেই বুঝবি।“
খুশিতে মনটা ভরে উঠলো ওর। কথাটা সন্ধ্যাকে জানাতে হবে। কিন্তু সন্ধ্যাকে হোয়াটস্যাপ এ অফলাইন দেখাচ্ছে। বাড়ি ফিরেছে ১০ মিনিট আগে টেক্সট করেছিল। ও একটা ছোট্ট মেসেজ দিয়ে রাখলো, “কল করো”। মনের সুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালো রঞ্জ।
দুই সপ্তাহ পর।
রঞ্জন এসেছে জিতুর বিয়ে এটেন্ড করতে। সন্ধ্যার সাথে আর যোগাযোগ করা যায় নি। কোথাও খুজেই পেল না সন্ধ্যা কে। ওর এক বান্ধবী মারফত খবর পেল সন্ধ্যার কোন আত্মীয় নাকি অসুস্থ। তাই দেশের বাইরে গেছে। কিন্তু ফোন কেন করছে না এটাই পরিষ্কার না রঞ্জনের কাছে। যাই হোক। জিতুর বিয়েতে এসে এসব চাপ নিতে ইচ্ছে করছে না। এঞ্জয় করতে থাকলো। অনেক দিন জিতুকে দেখে নি, তার উপর কাকীর সাথে পরিচিত হওয়া। আরিব্বাস…
সাত দিন পর। কালকে চলে যাবে রঞ্জনরা। আজকে ওদের ঘুড়তে বের হবার কথা। পারমিতা, অর্থাৎ রঞ্জনের কাকী, দেখতে রঞ্জনের সন্ধ্যার মতই সুন্দরী। আজকে ওরা সবাই ঘুরতে বের হবে। কিন্তু, রঞ্জন এর বের হবার ইচ্ছে নেই। খুব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। সকালের নাস্তার সময় বলল, “কাকা তোরা সবাই ঘুরে আয়, আমার শরীরটা ভাল নেই। ধকলটা নিতে পারছি না। আমি বরং রেস্ট নেই।“
“হ্যা ঠিক আছে। রেস্ট নে। শরীর কি বেশি খারাপ হল?”
“না এরম কিছু না। ঘুম হয় নি ঠিক মত। ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে।“
“আচ্ছা তাহলে ঘুমা।“
রঞ্জন এবার উঠে ওর মায়ের কাছে গেল। “মা, আমার রুমের গিজারটা কাজ করছে না। কাকাকে বল তো একটু ঠিক করে দিতে।“
“ও মা। আমি কি বলব? তুই বল।“
“আরে কাকা বিয়ে করেছে। তুমি বৌদি হউ, ডাকতে পারো। আমি তো পারি না।“
“আচ্ছা, ছেলে আমার বেশি পেকেছে। এবার তোকেও বিয়ে করাতে হবে, তাই না?”
“হাহাহা।“
আধাঘণ্টা পর, সবাই বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে যাবার আগে জিতু এসে রঞ্জনের ঘরের গিজারের কানেকশন চেক করে দিয়ে গেল। বলল, “এবার আর সমস্যা নেই।“
সবাই বেরিয়ে গেছে। রঞ্জন একা। রঞ্জন স্নানে যাবে। একটা সিগারেট ধরালো। ভালমত সিগারেটটা খেল। চঞ্চল মন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললে মনে আর চাঞ্চল্যটা থাকে না। রঞ্জন এখন সেরকমই শীতল অবস্থায় আছে। ভাল মত শেষ টানটা টেনে নিল সিগারেটের। সিগারেটের বাট এশট্রেতে গুজে, কাকার শেখানো নিয়মে ধোয়ার রিং ছাড়ল বাতাসে।
গোসল খানায় গেল। গিজার এর সুইচ অন করে রেখেছিল মিনিট কুড়ি আগে। জল গরম হয়ে যাবার কথা। ভেতরে নিজের সব পোশাক খুলে নগ্ন হয়ে নিল। একবার নিজের মনে বলে উঠল,”কত কি করার ছিল যে…”
কলের চাবিটা হাত দিয়ে ধরল জলের ফোয়ারা ছাড়বে বলে।
সন্ধ্যার দিকে সবাই বসে আছে জিতুদের ফ্ল্যাটে। পুলিশ এসেছে। ওদের বাথরুমে রঞ্জনের লাশ পাওয়া গেছে। ময়না তদন্ত করার জন্য লাশ নেওয়া হবে হাসপাতালে। কেমন একটা থমথমে পরিবেশ। রঞ্জনের মা বিলাপ বকছেন। জিতু একদম হতভম্ব। সবচেয়ে বেশি মুষরে পরেছে রঞ্জনের কাকী, পারমিতা। পারমিতার দাবী এটা হত্যা। ও নিশ্চিত এটা হত্যা। কারও সাথে কথা বলছে না সে।
দু সপ্তাহ পর।
জিতুর নামে কেস হয়েছে। রঞ্জনকে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করার দায়ে। পারমিতা বাদী হয়ে কেস করেছে।
পারমিতার বক্তব্যঃ আমি আর কেউ নই, আমি রঞ্জনের প্রাক্তন প্রেমিকা সন্ধ্যা। এটি আমার ডাকনাম। ভাল নাম পারমিতা বক্সি। বাবা জোড় করে আমাকে বিয়ে দিয়ে দেন আমার মতামত ছাড়াই। আমি রঞ্জনের থেকে বিদায় ও নিয়ে যেতে পারি নি। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমার বাবার পছন্দ করা বর আর কেউ নয়, রঞ্জনের বন্ধুসমতুল্য কাকা, জিতু। এটা অবশ্য আমরা কেউ ই জানতাম না। কিন্তু বিষয়টা আবিষ্কার হয় বিয়ের দিন। আমি রঞ্জনকে দেখে চমকে উঠি। কিন্তু আমরা দুজনেই ম্যাচিওর আচরণ করি। আমরা পরে নিজেরা সিদ্ধান্ত নিই যে জিতুকে এটা কোনও অবস্থাতেই জানতে দেওয়া যাবে না। আমরা চেপে যাব বিষয়টা। কিন্তু আমি ভালবাসতাম রঞ্জনকে। জিতু আমার কাছে আসতে চাইছিল, যেহেতু আমি ওর স্ত্রী। কিন্তু আমি রাজী ছিলাম না। তাই ওর কাছে সময় চেয়েছিলাম। কিন্তু জিতু অপেক্ষা করতে রাজি ছিল না। এর মধ্যে কোনও এক ভাবে জেনে যায় জিতু যে আমার পূর্বে সম্পর্ক ছিল। তাই ও আমাকে রঞ্জন খুন হবার আগের রাতে এই কথা তুলে এবং প্রাক্তনের খবর জানতে চায়। আমি অস্বীকার করি। পরে ও আমার কাছে আসতে চাইলে আমি আরও সময় চাই। এক পর্যায়ে জিতু আমাকে ধর্ষণ করে। পরে হয়তো কোনও ভাবে জেনে গেছিল যে আমার প্রাক্তন আর কেউ নয়, রঞ্জন। তখন রঞ্জনকে হত্যা করে।
জিতুর বক্তব্যঃ আমি জানতাম না পারমিতা আর সন্ধ্যা অভিন্ন। জানলে আমি কখনও বিয়ে করতাম না। রঞ্জন আমার কলিজার টুকরা। আমি রঞ্জনকে কষ্ট দিতে চাই নি। কেউ একজন আমাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানায় পারমিতার অনেক ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে কারও সাথে। কিন্তু আমি এটা জানতাম না সেটা কে। হ্যা আমি রিপুর তাড়নায় ধৈর্য্য ধরতে পারি নি। জোড় করে নিয়েছিলাম পারমিতাকে। কিন্তু আমি রঞ্জনকে হত্যা করি নি।
হত্যার প্রমাণঃ রঞ্জন হত্যার দিন, সবার ঘুরতে যাবার কথা ছিল। রঞ্জন অসুস্থ ছিল বলে যায় নি। কিন্তু রঞ্জনের রুমের স্নানঘরের গিজার নষ্ট ছিল। সেটা ঠিক করবার জন্য রঞ্জন ওর মায়ের মারফত জিতুকে বলে। জিতু হিংসার বশবর্তী হয়ে ঠিক করবার সময় গিজারের কলের সাথে শর্টসার্কিট করে দেয়। জিতু যে এই কাজে ওস্তাদ ও সর্বশেষ জিতুই ঐটার সার্কিটে হাত দিয়েছিল তার সাক্ষী আছে। পরে এক্সপার্টরা দেখেছে যে শর্ট সার্কিট ইচ্ছাকৃত। এটা দুর্ঘটনা নয়। যেহেতু রঞ্জন বলেছে গিজার ঠিক করাতে, এবং পরের দিন ওরা চলে যেত। তাই রঞ্জন ওটা ব্যবহার করতই। এভাবে রঞ্জন তরিৎপৃষ্ট হয়ে মারা যায়। এটি একটি মার্ডার।
ব্যবচ্ছেদঃ রঞ্জন বিয়ের অনুষ্ঠানে পারমিতাকে দেখেই বুঝল কেস বিরাট। এটা সন্ধ্যা। কিন্তু এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। সন্ধ্যাকে চোখে ইশারা করল কথা বলতে চায়। ওরা ব্যক্তিগতভাবে কথা বলে জানল, সন্ধ্যার বাবার চাপাচাপিতে এই ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এখন আর এটা জিতুকে জানানো যাবে না। রঞ্জন বিদেশে চলে যাবে। ওরা থাকুক এখানে। সন্ধ্যা কিছুদিন পর ভুলে যাবে রঞ্জনকে। কিন্তু এর মধ্যে সন্ধ্যার পেছনে ঘুরতে থাকা কোনও এবিউজার জিতুকে জানায় সন্ধ্যার ব্যাপারে। জিতু সন্ধ্যাকে ধর্ষণ করে। এই খবর জিতু আবার নিজেই গিয়ে সেদিন রাতেই রঞ্জনকে জানায়। যেহেতু দুজনই একে অপরের কাছে কিছুই লুকাতো না। রঞ্জন বিষয়টায় মনে খুব আঘাত পায়। কিন্তু ওর কিচ্ছু করার নেই। ও ওর কাকাকে কিছু বলতেও পারবে না। সন্ধ্যাকে বাঁচাতেও পারবে না। জানে সন্ধ্যা কোনও স্টেপ নেবে না। তাই সারারাত বসে ও একটা প্লান বানায়। রাতে নিজেই স্নানঘরের গিজার নষ্ট করে। পরের দিন মা কে দিয়ে কাকাকে বলিয়ে সেটা সারায়। এরপর সবাই বেরিয়ে গেলে নিজে সেটাতে একটা শর্ট সার্কিট ক্রিয়েট করে। এরপর জেনে বুঝে তড়িতায়িত অবস্থায় থাকা কলের চাবিতে হাত দেয়। তরিতাহিত হয়ে রঞ্জনের মৃত্যু হয়। যা মূলত আত্মহত্যা। কিন্তু সে জানে এবার মুখ খুলবে সন্ধ্যা অর্থাৎ পারমিতা। ফলাফলে জিতুর থেকে আলাদা হয়ে যেতে চাইবে। কারণ সে ভাববে জিতু খুন করেছে রঞ্জনকে। প্রতিটা এভিডেন্স ও সেভাবেই সাজানো। কারণ এভাবে কেউ আত্মহত্যা করবে না। আর রঞ্জনযে এসব কাজ জানে এটা কেউ ভাবতেই পারবে না। রঞ্জন তাই এই প্লানটা করে। নিজের কষ্ট থেকে মুক্তি, সন্ধ্যার মুক্তি, জিতুর শাস্তি বা আলাদা করা, যাই হোক।
তড়িতাহিত অবস্থায় থাকা কলে হাত দেবার পূর্বে রঞ্জন বলছিল নিজেকে, কাকা তুই বললে তো আমি সব করতে পারতাম। কিন্তু ধর্ষণ করাটা তোর উচিৎ হয় নি। হোক না তোর নিজের বিয়ে করা বউ। সম্মতিটা দরকারি।
রঞ্জনের সুইসাইড নোটঃ
“তোকেও ভালবাসি, কাকা। তোমাকেও, সন্ধ্যা। কিন্তু উপায় নেই আমার। আমি আর পারছি না নিতে। তাই আত্মহত্যা করে সেটাকে খুন সাজিয়ে রেখে গেলাম। কাকার জন্য আমি সব করব। কিন্তু পারমিতার কষ্ট আমি নিতে পারব না। ধর্ষণ করাটা উচিৎ হয় নি। কিন্তু এটা কেউ জানবে না।“
এরপর সেটা সিগারেট ফুকতে ফুকতে পুড়িয়ে ছাইদানিতে ফেলে দেয়।
এখন ৮ বছর পর প্যারলে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে জিতু বড্ড একা। কোথাও তার কেউ নেই। কিন্তু সে যে নির্দোষ। তার রঞ্জনকে সে খুন করে নি।
Last edited: